Saturday, September 23, 2017

সাইকোলজিক্যাল টিপস -৩৩:আত্ম ধারনাও আত্ম ভাবমূর্তি যেভাবে উজ্জ্বল ও সবল করবেন

আমার লেখা বই "উদ্বেগ - টেনশন: মনো- বৈজ্ঞানিক সমাধান" এর ৫ম অধ্যায় থেকে এ লেখাটি দিচ্ছি

আমাদের রয়েছে কয়েকটি আত্ম- ধারনা(self concept)ও আত্ম- ভাবমূর্তি(self image)  এবং আত্ম ছবি(self- pictures) । এই প্রতিটি আত্ম ধারনা বা আত্ম ভাবমূর্তি হচ্ছে বিশেষ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি।

১। মনোগত সত্বা(subjective self):

এটি হচ্চে ব্যক্তিগত ভাবে আমরা নিজেকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে থাকি; নিজের সমন্ধে নিজের অভিমত

এটি তৈরি হয় আমাদের বৈশিষ্ট্য গুলো সমন্ধে আমাদের নিজস্ব মুল্যায়ন ও চিন্তা ভাবনার ধরন থেকে।

এগুলো প্রভাবিত হয়- মা- বাবা সন্তানকে কিভাবে দেখে,ভাবে ও মনে করে,সঙ্গী-সাথী ও বৃহত্তর সমাজ আমাদের কিভাবে মুল্যায়ন করে তার দ্বারা
শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে  তৈরি এই মনোগত  সত্বা তাই অনেকেরই নেতিবাচক হয়।নিজের কাছেই নিজকে অপছন্দের,ঘৃনার মনে হতে পারে।যেহেতু এটি অন্যদের কথা,মন্তব্য থেকে তৈরি সত্বা এবং এটি আমরা নিজকে নিজে কেমন ভাবি তেমন সত্বা,তাই এটিকে পুনর্গঠন করে ইতিবাচক করে নিতে হবে।

২। বাস্তব / বস্তুনিষ্ঠ সত্বা(objective self):

এটি হচ্ছে অন্যরা আমাদের কিভাবে দেখে; অন্যরা আমাদের যেরকম ব্যক্তির বলে ভাবে

সবাই আমাদের একরকম ভাবে দেখে না।কেউ ভালো জানে,আবার কেউ ভালো জানে না।আমরাও বাসায় একরকম, স্কুল কলেজে একরকম আবার কর্মক্ষেত্রে অন্যরকম।

কিছু লোক আআমাদের পছন্দ করবে তারা, আবার কিছু লোক অপছন্দ করবে।তাই কেউ মন্দ ভাবলে এতো পেরেশান হওয়ার কারন নেই।প্রিয়জনদের ভাবনাকে গুরুত্ব দিন,সমালোচকদের মন্তব্যকে অগ্রাহ্য  করুন।

৩। সামাজিক সত্বা(social self):
এটি হচ্ছে অন্যরা আমাদের কিভাবে দেখছে বলে আমরা মনে করি; নিজেদের মতামত যে আমাকে অন্যরা এরকম ভাবে।

নেতিবাচক ও কম আত্ম মর্যাদা সম্পন্ন মানুষদের এই পারসেপশন অনেক ক্ষেত্রেই ভুল হয়ে থাকে।তারা মনে করে অন্যরা তাকে ভালো মানুষ মনে করে না,পছন্দ করে না বা সম্মান,গুরুত্ব দেয় না।আমরা অনেকেই অন্যরা আমাদের গ্রহনযোগ্য ভাবে কিনা,আমাদের চিন্তা-মত- স্বভাবকে ভালো সার্টিফিকেট দিচ্ছে কিনা,আমাদের কাজ- আচরনকে অনুমোদন করছে কিনা,মেনে নিচ্ছে কিনা- ইত্যাদি ব্যাপারে বেশ সেনসিটিভ থাকি।একে বলা হয় " সামাজিক গ্রহন যোগ্যতার" কাঙ্গালিপনা। এই কাঙ্গালিপনা থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

৪। আদর্শ সত্বা(ideal self):
এটি হচ্ছে আমরা যেরকম হতে চাই তেমন সত্বা; যে রকমটি আমরা হয়ে উঠতে চাই।

কম লোকই নিজকে নিয়ে পূর্ন পরিতৃপ্ত।কিছু ক্ষেত্রে হলেও অন্যরকম হতে চাই।কেউ বা সম্পূর্ণ নতুন কেউ হয়ে উঠতে চান; আরেকটি জীবন পেলে ওরকম হতে চাইতাম বলে আফসোস করেন।

কিছু ক্ষেত্রে " আদর্শায়ন" এর প্রয়োজন থাকতে পারে।কিন্তু তাই বলে নিজের বর্তমান সত্বাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট,অতৃপ্ত থাকলে সুখী হওয়া কঠিন।

অতি উচ্চ মাত্রার লক্ষ্য অর্জন করার সংগ্রামে আমরা জীর্ন,ক্ষীন ও নিঃশেষ হয়ে যেতে পারি।তাই আত্ম ধারনা বাস্তবভিত্তিক করে, ইতিবাচক করে,আত্ম মর্যাদা বাড়িয়ে এই আফসোস কমানো সম্ভব

উপরোক্ত বিভিন্ন সত্বার মধ্যে যত পার্থক্য থাকবে আমাদের অতৃপ্তি, অসন্তুষ্টি,হীনমন্যতা তত বেশি থাকবে।সবগুলো সত্বা একই রকমের হলে সেটা হতো আদর্শমান।তবে এরকমটি বাস্তব সম্মত ধারনা নয়।

নিজের মনোগত সত্বাকে ইতিবাচক, বলিষ্ঠ করে

,বাস্তব সত্বার যতটুকু  নিজের অনুকুলে  সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে,

সামাজিক সত্বাকে  নেতিবাচক ভাবে কম মূল্যায়ন করে

ও আদর্শ সত্বাকে অতি উচুতে না রেখে বাস্তব সম্মত করে নিলে

এই পার্থক্য গুলো অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।

এভাবে উজ্জ্বল, সবল ও মর্যাদা পূর্ন আত্ম ধারনা ও আত্ম ভাব মূর্তি তৈরী করে আমরা সুখী ও সম্মানিত জীবন যাপন করতে পারি

Saturday, September 9, 2017

সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল -১৫: স্ট্রেস/ মানসিক চাপ

পর্ব-১: মনে চাপ পড়লে শরীর কেন ব্যাথা পায়?( এরা জমজ ভাই- বোন তো তাই)

আমার " মন ও মানুষ" বইয়ের ৩য় অধ্যায়- " মানসিক চাপ: স্ট্রেস,জীবনের ঘাত- প্রতিঘাত- যেভাবে মোকাবিলা করবেন" থেকে নির্বাচিত অংশ তুলে দেবো
( নিজ বই থেকে তুলে দিলে চৌর্যবৃত্তি হবে না তো?)

মনের উপর চাপ পড়লে( বোন) , কেন তার জমজ ভাই ( শরীর)  ব্যাথা পায়?

এর রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আসুন জানি কি সে ব্রেইন মেকানিজম :

মানসিক চাপের ফলে ব্রেইনের " হাইপোথেলামাস" থেকে সিআরএইচ হরমোন নিঃসরন হয়> সেটি এসিটিএইচ হরমোন নিঃসরন করে> যা এড্রিনাল কর্টেক্সকে সক্রিয় করে >ফলে গ্লুকোকরটিকয়েড এর পরিমান বেড়ে যায়।
এই গ্লুকোকর্টিকয়েড- শরীরকে জরুরি অবস্হায়( ইমারজেন্সী) যা যা করনীয় তা করতে সামর্থ্য জোগায়- অনেকটা যুদ্ধাবস্হায় রাস্ট্র যা করে তেমন( বাংলাদেশ - মায়ানমার নয়,ভারত- পাকিস্তান বা ভারত- চীন যুদ্ধাবস্হায় গেলে যেমন ঘটে)।
কি করে? শরীরকে বাড়তি শক্তি জোগায়,( সব ধরনের কেন্দ্রীয় রসদ জোগান দেওয়া)  , বিপদ মোকাবিলায় হার্টকে অধিক সক্রিয় করে তোলে( এটি হচ্ছে ক্যান্টনমেন্ট )।

অন্য দিকে শরীরের স্বাভাবিক কাজ- কর্ম স্হগিত হয়ে পড়ে( দেশে জরুরি অবস্হায় যেমনটি ঘটে-) 

- স্বাভাবিক বেড়ে উঠা( গ্রুথ), প্রজনন করা,রোগ  প্রতিরক্ষা ব্যবস্হার দিকে কম নজর দেওয়া( বহিঃশক্তির আক্রমন রোখা তখন প্রধান লক্ষ্য) ।

প্রকৃত বিপদ মোকাবিলার জন্য স্রষ্টা আমাদের ব্রেইনে এরকম " প্রতিরক্ষা " ব্যবস্থা তৈরী করেছেন,যাতে আমরা বিপদকে ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারি। কিন্তু ব্রেইন যখন ভুল করে " ধারনাগত" বিপদাশঙ্কা বা " উদ্বেগে" বার বার এরকম ইমার্জেন্সী অবস্হা জারি করে তখন এই ক্রমাগত ও প্রায় স্হায়ী যুদ্ধাবস্হার কারনে আমাদের সকল সহায়,সম্পদ, শক্তি নষ্ট হয়ে যা।(  ধরুন বাংলাদেশকে যদি এরকম অকারনে ২০ বছর যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়,দেশের ও আমাদের অবস্হা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাড়াবে?)

যারা দীর্ঘ স্হায়ী ও  উপরযুপরি " স্ট্রেস বা চাপের" মুখে থাকে তাদের অবস্থা এরকমই হয়।

এবার দেখা যাক স্ট্রেসের ফলে কি হয়:

১। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা( ইম্যুনিটি) কমে যায়-

ইম্যুনিটির প্রায় সব উপাদানই মানসিক চাপ,উদ্বেগ,উৎকন্ঠার কারনে পরিবর্তিত হয়ে যায়।ফলে তারা সহজে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন,বিশেষ করে ভাইরাস জনিত রোগে।" কোষ নিয়ন্ত্রিত" ইম্যুনিটি কমে যায়।এমনকি  রোগ প্রতিরোধের জন্য আমরা যে" ভ্যাকসিন" দেই এর কার্যকারিতা ও কমে যায়।( ঠেলা এবার সামলান)

২। অনিদ্রা বা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে- এই অনিদ্রার কারনে ও  ইম্যুনিটির " এন- কে" কোষ ও "আই এল " নামক দুটি গুরুত্ব পূর্ন উপাদান কমে যায়।ফলাফল আরো রোগের ঝুকি বৃদ্ধি পায়।

৩। শরীর দুর্বল, কাহিল হয়ে পড়ে-

এর কারন " সাইটোকিনস" এ পরিবর্তন। তাই শারীরিক রোগ না থাকা সত্বেও তারা অল্পতে হাপিয়ে উঠেন,পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না।

৪। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ব্যাথায় ভুগেন-

এর কারন " সাইটোকিনস" এর মাত্রায় হেরফের ঘটে।এই সাইটোকিনসের জন্য ব্রেইনের ব্যথা অনুভবের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।ফলে বিভিন্ন ধরনের শারিরীক ব্যথায় আক্রান্ত হন,যেগুলো শুধু কষ্টদায়ক নয়,দীর্ঘস্থায়ী ও হয়ে থাকে।

৫। স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া-

এর কারন " এন্ডোটক্সিন" নামক হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া।ফলে অস্হিরতা,উৎকন্ঠা বেড়ে যাওয়ার সাথে মনে রাখার ক্ষমতা কমে যায়।

৬ সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ন হচ্ছে " হার্টের" সমস্যা -

হার্ট এ্যাটাকের প্রধান কারন রক্তনালীতে ক্রমশ চর্বি জমে শক্ত ও মোটা হয়ে যাওয়া।রক্তনালির এই মোটা ও শক্ত হয়ে যাওয়ার প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে মানসিক চাপ ও বিষন্নতার ভূমিকা রয়েছে।চাপের ফলে রক্তের একটি মার্কার " এস- আই- সি- এ- এম" এর পরিমাণ খুবই বেড়ে যায়।এই মার্কারের পরিমান বেশি হলে " হার্ট এ্যাটাকের" সম্ভাবনা বেড়ে যায়

৭। বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন - ক্রমাগত চাপ বিষন্নতা রোগ সৃষ্টি করে।আবার হার্ট এ্যাটাকের পর উপরের মার্কার বেড়ে যাওয়ার কারনেও বিষন্নতা রোগ দেখা দিতে পারে।

৮। গিড়ায় গিড়ায় ব্যথা- বা রিমাটয়েড আর্থারাইটিস: এটি এক ধরনের অটো-ইম্যুইন ডিজিজ।ক্রমাগত চাপের ফলে মস্তিস্কের চাপ নিয়ন্ত্রন অক্ষ" এইচ পি এ" দুর্বল হয়ে পড়ে।ফলে অটো ইম্যুনিটিকে দাবিয়ে/ চাপিয়ে রাখা যায় না।চাপ বা বিষন্নতায় তাই বাতের ব্যথা বাড়ে ও তা দীর্ঘ স্হায়ী হয়।

৯ সোরিয়াসিস-: একটি মারাত্মক ধরনের চর্ম রোগ।মনোচিকিৎসায় তারা ভালো ফল পেয়ে থাকেন।

১০। এমনকি ক্যানসার-: এদেরকে ও মনোচিকিৎসা দিয়ে বেচে থাকার সময় বাড়ানো যায়( তবে হোমিওপ্যাথির মতন এ দাবী নয় যে ক্যানসার এভাবে ভালো করা যায়)। ক্যানসারের শেষ অবস্হায় কেমোথেরাপির যন্ত্রনাদায়ক চিকিৎসার চেয়ে মনোচিকিৎসা কম কার্যকর নয়

Wednesday, September 6, 2017

সাইকোলজিক্যাল টিপস: ধর্ষন: প্রতিকার ও প্রতিরোধে করনীয়

দেশে ধর্ষন যেন থামছেই না।ধর্ষনের " তুফান" তুফান গতিতে  অব্যাহত রয়েছে। আইন ও শালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী  এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত  ধর্ষনের সংখ্যা ২৮০ জন,এর মধ্যে ধর্ষনের কারনে মারা গেছে ১০ জন ও  ধর্ষনের কারনে আত্মহত্যা করেছে ৫ জন।অন্যদিকে শিশু ধর্ষনের হার প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে ৩ গুন বেশি। আফ্রিকায় এরকমটি অনেকটা মহামারি আকার ধারন করেছে।সে জন্য সেখানে ধর্ষনের শাস্তি প্রকাশ্যে গলা কর্তন এবং ক্ষেত্র বিশেষে ধর্ষককে হাত বেধে উপরে ঝুলিয়ে রেখে অন্ডকোষে বড় পাথর বেধে ঝুলিয়ে রাখা।
ধর্ষনের শ্রেনি বিভাগ:
পরিস্হিতি অনুযায়ী :অভিসার/ দাওয়াত ধর্ষন; শিশু ধর্ষন; দলবদ্ধ ধর্ষন; পরিচিতজন দ্বারা ধর্ষন; দাম্পত্য ধর্ষন; পরিবারের লোক দ্বারা ধর্ষন- ইত্যাদি
লক্ষ্য অনুযায়ী :ক্রুদ্ধ ধর্ষক( এনঙ্গার রেপিস্ট); ক্ষমতা দেখানো ধর্ষক( পাওয়ার  রেপিস্ট); পীড়নকারী ধর্ষক( সেডিস্ট রেপিস্ট)।
ধর্ষকের কিছু বৈশিষ্ট্য :শিশুকাল থেকে ছোট - বড় অপরাধের ইতিহাস থাকে;  এরা যৌন ও শারিরিক নির্যাতনের শিকার ; এরা প্রায়শ ভাঙ্গা সংসার/ অকার্যকর সংসার থেকে আগত; এরা বাউন্ডেলে,উচ্ছৃঙ্খল, বখাটে স্বভাবের; এদের বিবেক তৈরী হয় না বা হলেও ক্রটিপূর্ন;অপরাধ করে অনুতপ্ত হয় না; নিষ্ঠুর, নির্মম মানস গঠনের; এরা নিয়ন্ত্রণহীন পশুর মতন।

ধর্ষনের মনস্বতাত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জরুরী তবে বর্তমানে তারচেয়ে বেশী জরুরি ধর্ষন প্রতিকার ও প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহন।
সকল প্রকার সতর্কতা ও সাবধানতা সত্বেও আমরা হয়তো ধর্ষন পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারবো না,তবে সচেতনতা,সতর্কতা ও সামাজিক- আইনি প্রতিকার এ সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে পারে।
প্রতিরোধের জন্য ঔঔনারীকে এভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে যেন তারা দৃড়ভাবে বিশ্বাস করতে শিখে যে " না" বলার ও " আত্ম রক্ষার" অধিকার ও সক্ষমতা তার রয়েছে।নারী ধর্ষনের প্রধানতম অনুসঙ্গ হচ্ছে সকল যৌনতার প্রতীক নারীতে আরোপ করার সমাজ- সাংস্কৃতিক প্রবনতা।শুধু মাত্র নারীকে " সেক্সুয়ালাইজড" করার এই ধারাকে প্রতিহত করতে হবে।নারীকে" মানুষ"  নয় " সেক্স" হিসেবে ভাবার পুরুষতান্ত্রিক দৃস্টিভঙ্গির আমুল পরিবর্তন করতে হবে।
প্রতিরোধের উপায়: প্রথমেই প্রয়োজন ধর্ষন সংস্কৃতিকে উচকে দেয়,প্রশ্রয় দেয় তেমন সমাজকে ধর্ষন বিরোধী, ধর্ষন প্রতিরোধী সমাজে রূপান্তর করা।এর জন্য গল্প,উপন্যাস, নাটক,সিনেমা,বিজ্ঞাপনে নারীকে "যৌন পন্য" হিসেবে আকর্ষণীয় ভাবে উপস্হাপন বন্ধ করতে হবে।নারীকে " সেক্সুয়ালাইজড" করার কালচার বদলে ফেলে তাকে" মানুষ" হিসেবে ভাবার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।

অন্য দিকে সমাজে যে সব মিথ,বিশ্বাস ধর্ষনকে প্রশ্রয় দেয় তেমন মিথগুলোকে ভেঙ্গে দিতে হবে।তেমন কিছু প্রচলিত মিথ হচ্ছে: নারীর উগ্র পোষাক,চাল- চলন ধর্ষনকে উৎসাহিত করে; নারী ধর্ষিতা হতে চায়; নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না,তাই তাকে বার বার " আহ্বান " জানাতে হবে; পুরুষরা অধিক যৌন- কাতর,তাই তারা নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না; ভূমি দস্যুদের মতন এই যৌন দস্যুদের মানসিকতা এই যে নারীর দেহের উপর সে "অধিকার প্রাপ্ত"( এনটাইটেলমেন্ট); একবার শারিরিক সম্পর্ক হওয়া মানে পরবর্তীতে ও সে অধিকার থাকবে; রাত- বিরাতে নারীর একাকী চলাফেরা ধর্ষনের অন্যতম কারন; ধর্ষিতার শরীরে আঘাতের চিন্হ নেই,তাই তার নীরব সমর্থন ছিল- ইত্যাদি ভ্রান্ত বিশ্বাস সমাজ থেকে দূর করতে হবে।

এছাড়া ও ধর্ষন সংস্কৃতি  পরিবর্তনে আরো যা যা  করতে হবে: ধর্ষন প্রতিরোধে শুধু নারীকে সতর্ক থাকতে বললে হবে না,পুরুষকে ও " ধর্ষন করবে না" এই বার্তা বার বার দিতে হবে; পরিবার, সমাজে অন্যের " অনুমতি/ সম্মতি" নেওয়ার ( কনসেন্ট)কালচার তৈরী করতে হবে; প্রচার মাধ্যম,ভিডিওতে যৌন সুরসুরি দেওয়া প্রোগ্রাম বন্ধ করতে হবে; পৌরুষত্বের সনাতনী ধারনায় পরিবর্তন আনতে হবে; ধর্ষন " প্রাকৃতিক" ব্যাপার এ ভুল ধারনা ভেঙ্গে একে " অপরাধ " ও নারীর প্রতি " সহিংসতা " হিসেবে দেখতে হবে; ধর্ষন মানে ধর্ষন, প্রেম - বন্ধুত্বের নামে একে " বৈধতা" দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে না; চোখের সামনে ধর্ষন হচ্ছে অথচ নির্বিকার, নিষ্ক্রিয় থাকার কাপুরুষতা পরিহার করতে হবে; সামাজিক / আইনগত হয়রানি, অসম্মানের ভয়ে ধর্ষনের ঘটনা লুকিয়ে রাখা যাবে না;- ইত্যাদি ।

সম্ভাব্য ভিকটিমদের করনীয় :আপনি কোথাও বা কারো কাছে নিরাপদ কিনা সে ব্যাপারে নিজের অন্তর্জ্ঞান( ইনটুইশন) ও মন যা বলে সেটিকে গুরুত্ব দিন; চার- পাশের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখুন; তেমন কিছু সঙ্গে রাখুন যা প্রয়োজনের সময় অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কাজে লাগবে( হুইসেল,এলার্ম); আত্মরক্ষার কৌশল শিখুন; রাস্তায় হাটার সময় নির্জন, পরিত্যক্ত এলাকা এড়িয়ে চলুন ; সঙ্গে মোবাইল ফোন রাখুন; আত্মবিশ্বাসী, সাহসী মনোভাব রাখুন; মোবাইলে " কোড ওয়ার্ড" রাখুন, যাতে বিপদের সময় সাঙ্কেতিক ভাবে পরিবারের লোক/ বন্ধুদের জানাতে পারেন; ফলো করছে মনে করলে পাশের বাড়ীতে ঢুকে পড়ুন; পার্টিতে দল বেধে  ও বিশ্বস্ত লোক নিয়ে যাবেন ; সেখানে মদ খাবেন না; বিপদ আচ করলে কোন এক ওছিলায় বের হয়ে আসার চেষ্টা করুন।যদি একান্তেই আক্রমনের মুখে পড়ে যান: স্পস্ট ও দ্যর্থহীন ভাষায় নিজের অবস্হান পরিষ্কার করুন; এটি ধর্ষন স্মরন করিয়ে দিন; কোড ওয়ার্ড থাকলে ব্যবহার করুন ; কোন অজুহাত দাড় করান( পিরিয়ড চলছে বা যৌনবাহিত রোগ রয়েছে); অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য  চিৎকার করুন,নখ দিয়ে খামচে ধরুন,চুল ধরে হেচকি টান দিন; কামড় দিন,লাথি, ধাক্কা দিন- এভাবে কোন রকমে নিজকে ক্ষনিকের জন্য মুক্ত করতে পারলে দৌড়ে পালিয়ে আসুন; সরাসরি পুলিশের কাছে যাবেন,হাত ধুবেন না বা এমন কিছু করবেন না যাতে শারিরিক আলামত নষ্ট হয়ে যায়।যদি ছুরি বা আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে দাড়ান: আপনার বাধা তাকে আরো হিংস্র করতে পারে,তাই যদি আক্রমন করতেই চান তা হতে হবে- অপ্রত্যাশিত,হঠাৎ ও খুবই কষ্টদায়ক ( বিশেষ করে তার অন্ডকোষ,চোখের কোটর,শ্বাসনালীকে টার্গেট করতে হবে)।

সমাজ ও রাস্ট্রীয় উদ্যোগ: ব্যক্তিকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে ঠিক,তবে ধর্ষন প্রতিরোধে মূল দায়িত্ব নিতে হবে সমাজ ও রাস্ট্রকে।আমেরিকায় সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ( সিডিসি) কেন্দ্রীয় ভাবে " রেপ প্রিভেনশন এন্ড এডুকেশন "( আর,পি,ই) প্রোগাম চালু করেছে।

এ ধরনের জাতীয় প্রোগ্রাম আমাদের ও নিতে হবে,যেখানে পৃথিবী ব্যাপী পরিক্ষিত ও বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত কার্যকর " প্রতিরোধ " প্রোগ্রাম গুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।বৈজ্ঞানিক গবেষনায় কার্যকর প্রমানিত এমন ৩ টি প্রোগ্রাম হচ্ছে: ১) সেইফ ডেট- এতে ৫টি উপাদান রয়েছে এবং কিশোরীদের আবেগগত ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে এটি সফল বলে প্রমানিত। ২) শিফটিং বাউন্ডারিজ: ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি  ও ধর্ষন প্রতিরোধী মনোভাব তৈরীর চেষ্টা নেওয়া হয়।৩) রিয়েল কনসেন্ট- সামাজিক অনুধাবন ও সামাজিক আদর্শকে ব্যবহার করে সমাজমুখী,নৈতিক আচরন তৈরীর চেষ্টা নেওয়া হয়।

এ ছাড়াও আরো ৪ টি প্রোগ্রামকে " প্রতিশ্রুতিশীল " বলে গন্য করা হয়- ১। গ্রীন ডট প্রোগ্রাম - ডরোথি এডওয়ার্ড প্রবর্তিত এ প্রোগ্রামে সামাজিক মান দন্ডে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা ও ধর্ষনের কাছে থাকা জনগনকে প্রতিরোধে এগিয়ে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।২। ম্যান'স প্রোগ্রাম - জন ফুবার্ট প্রবর্তিত এ প্রোগ্রামে অন্যকে সম্মান করা,সম্পর্ক উন্নত করাসহ ভিকটিমের প্রতি সহমর্মি( এমপ্যাথি) হওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়।৩। ধর্ষনের পার্শস্হজনদের প্রো- একটিভ ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধকরণ - ভিক্টোরিয়া বেনিয়ার্ড  প্রত্যক্ষ দর্শীরা কখন,কিভাবে সহায়তায় এগিয়ে আসবেন সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এ প্রোগ্রাম তৈরী করেন।৪। এস এস: এস এসটিপি- প্রোগ্রাম।
আইনি সংস্কার : রেপ শিল্ড 'ল অনুসরন করতে হবে,যাতে ভিকটিমকে অনাবশ্যক  ক্রস এক্সাম না করা হয়,ব্যক্তিগত বিষয় বেশি প্রকাশ্যে আনা না হয়;তার অতীত যৌনতাকে উদাহরন হিসেবে টানা না হয়;অধিকতর প্রমানের বিধান রহিত করতে হবে; মেডিকেল পরিক্ষায় স্টান্ডার্ড প্রোটেকল মেনে চলতে হবে,অভিজ্ঞ প্রফেশনাল দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে,সব কিছুর ডকুমেন্টেশন রাখতে হবে,কোন চাপ,দুনীতির যেন অবকাশ না থাকে; ধর্ষকদের পূর্ন জীবন বৃত্তান্ত রেজিস্ট্রি করে তা সব জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে,ইন্টারনেটে তা প্রাপ্তির সুযোগ থাকতে হবে এবং কঠোর শাস্তির জন্য আইনি সংস্কার আনতে হবে- কয়েকটি দেশের ধর্ষনের শাস্তি এরকম: ভারত( ২০১৩ এর সংশোধিত আইন অনুযায়ী) - যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা আমৃত্যু কারা দন্ড; ফ্রান্স- ১৫-৩০ বছর জেল;চীন- ঘাড়ে গুলি করে মৃত্যু দন্ড; আফগানিস্তান - ৪ দিনের মধ্যে মাথায় গুলি করে মৃত্যু ;  এছাড়া ন্যুনতম সাজার উল্লেখ থাকতে হবে; বিচার দূ্রুত ও শাস্তি দৃশ্যমান করতে হবে।
শেষ করছি এক বিদেশি ধর্ষিতা নারীর উক্তি দিয়ে" আমার এ ক্ষত  প্রকৃত পক্ষে নিরাময়  হতে শুরু করে তখন,যখন আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম যা ঘটেছে তার জন্য আমি দায়ী নই"। ধর্ষনের মতন ঘৃন্য, কুৎসিত কাজের শিকার যে সব মা- বোন তাদের সে আবেগগত ক্ষত নিরাময়ে আমরা সাহায্য করতে পারি তাদেরকে আরো অসম্মান, হয়রানি,অপমানিত না করে, তারা পবিত্র, নিষ্পাপ ও দায়মুক্ত এই আস্হা,বিশ্বাস তাদের মনে ফিরিয়ে এনে তাদের আত্মসম্মান বোধকে চাঙ্গা করতে পারলে।

প্রফেসর ডা. মো. তাজুল ইসলাম
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কমিউনিটি এন্ড সোশাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্হ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
ই- মেইল:drtazul84@gmail.com
phone:01715112900