ইতিবাচক থাকা মানে এই নয় যে সব কিছু ওকে থাকবে
বরং ইতিবাচক থাকা মানে,
যা-ই ঘটুক আমি ওকে থাকবো
Wednesday, April 24, 2019
সাইকোলজিক্যাল টিপস -৫৮ঃ
Sunday, April 14, 2019
সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল --৪৫-ঃনুসরাত,আ্যাসান্জ ও কৃষ্ণ গহ্বর
"অবিচার দেখে ও তার প্রতিবাদ না করতে করতে, আমরা নিজেদের চেতনাকে সেই অবিচারের প্রতি অসাড় হয়ে উঠার প্রশিক্ষণ দেই।এবং ধীরে ধীরে নিজেদের ও আপনজনদের রক্ষা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি।"
জনগণের গোয়েন্দা, উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান আ্যাসান্জ এর এই উক্তি, আমাদের সমাজের জন্য পুরোপুরি সত্য।
প্রতিদিন রাস্ট্রীয়,সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক নানান রকমের অন্যায়, অবিচার হতে আমরা দেখি।আমরা কতজন সেগুলোর প্রতিবাদ করি?
রাস্তা ঘাটে, বাস-ট্রেনে শত শত অবিচার ঘটে যায়। আমরা "ভদ্রলোকরা" মান সম্মানের ভয়ে বা "কি হবে প্রতিবাদ করে " মনে করে বা "এটি দেখার দায়িত্ব আমার না" মনে করে, চোখ বুঝে সেগুলো উপেক্ষা করে যাই।
এভাবে অন্যায়,অবিচারের প্রতি আমাদের চেতনা বোধ অসাড় হয়ে পড়েছে।এসব এখন গা-সয়া হয়ে গেছে।
এজন্য অপশক্তি আরো বেপরোয়া ভাবে, প্রকাশ্যে নিজেদের অপকর্ম করার উৎসাহ পাচ্ছে।
আমাদের সমাজ আপোষকামীতা,তোষামোদি,সমঝোতা, অন্ধ আনুগত্য, সুবিধাবাদিতাকে গ্রহনযোগ্য, উচ্চ "সামাজিক গুন" মনে করে পুরস্কৃত করে।
শুধু তাই নয় একে "বুদ্ধিমানের কৌশল" বলে অন্যদের এরকম হতে উৎসাহিত করে।
আর যারা এরকম বিরূপ পরিস্থিতিতে ও সাহস করে প্রতিবাদ করে, তাদেরকে গোয়ার,, নির্বোধ, বে-খাপ্পা,অসামাজিক ইত্যাদি ভাষায় অভিহিত করে।
তবে এর কিছু ব্যতিক্রম আছে। নুসরাত সে ব্যতিক্রম। সে ও তার পরিবার আপোষ করলে, তথাকথিত সমঝোতা করলে বা কৌশলী হয়ে অনুগত থাকলে, তাকে এভাবে পুড়ে মরতে হতো না।
বরং হুজুরের বদান্যতায় প্রশ্ন পত্র পেয়ে ভালো রেজাল্ট করতো, ভবিষ্যতে আরো গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ উপহার পেতো।
নুসরাত ও আ্যাসান্জের মধ্যে মিলটি হচ্ছে তারা ব্যক্তি হিসেবে নগন্য, ক্ষুদ্র হলেও, প্রতিবাদ করেছে শক্তিমানদের বিরুদ্ধে।
এরকম করতে গিয়ে তারা নিজের নিরাপত্তা, স্বার্থেের কথা একবার ও ভাবেনি।
চেতনায় অসাড় সমাজে নুসরাত বাংলাদেশের মালালা,আরেক বিপ্লবী প্রীতিলতা।
আমাদের দেশ এককেন্দ্রিক শাসিত । কিন্তু স্হানীয় পর্যায়ে এমনকি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে, আমরা একেকটি "মোঘল সাম্রাজ্য " তৈরি করে রেখেছি।
এখানে একেকটি গোষ্ঠী স্হানীয় সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে।স্হানীয় রাজনীবিদ,সমাজ-নেতা,জনপ্রতিনিধি, আইনশৃংখলা বাহিনী ও অন্যান্য শক্তি মিলে একটি নিজস্ব "বলয়" তৈরি করে রাখে।
এই ক্ষমতা বলয়ের চারপাশে ঘিরে থাকে, একদল সুবিধা ভোগী মাস্তান চক্র।
নুর উদ্দীন, শামিমরা হচ্ছে সেই লাঠিয়াল বাহিনী।
অন্যদিকে বাকি সব আমজনতা "ভয়ে বা লোভে" এই বলয়ের অন্ধ আনুগত্য করে, তোষামোদি বা চামচামি করে থাকে।
যেসব শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রী অধ্যক্ষ রক্ষায় মিছিল ও আন্দোলন করেছে, এরা হচ্ছে সেই তোষামোদকারী, অন্ধ অনুগত বাহিনী।
এই চিত্র শুধু সোনাগাজীর নয়,এটি সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র।
ভালো মানুষ, সৎ,মানবিক, মেধাবী মানুষদের এখন কোন সামাজিক কদর,সম্মান নেই। বিভিন্ন স্তরে বিরাজমান সামাজিক, রাস্ট্রীয়,প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কেন্দ্র গুলো নিয়ন্ত্রিত হয়, ঐ রকম গোষ্ঠী গত অপশক্তি দ্বারা।
সেখানে মেধাবী, মানবিক মানুষরা থাকে অপাংক্তেয় হয়ে।
তাদেরকে কোনঠাসা করে, হেয়,নীচ করে রাখা হয়।ফলে সাধারণ মানুষ তাদেরকে অনুসরণ করবে দূরে থাক, তাদেরকে করুনা করে, তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে।
প্রতিটি হত্যা, ধর্ষণের আলাদা আলাদা কার্যকারণ থাকে। তবে এদের মধ্যে কমন কিছু ফ্যাক্টর ও থাকে।
নুসরাতকে যৌন হেনস্তা করা ও পরবর্তীতে প্রতিশোধ হিসেবে আগুনে পুড়িয়ে মারার ক্ষেত্রে, কয়েকটি বিষয় বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রথমতঃপূর্বে বর্নিত সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পুলিশী ছত্রছায়ায় যে শক্তির নেক্সাস তৈরি হয়ে রয়েছে, সে ক্ষমতা বলয়ের কারো অপকর্ম,অনাচারকে অবনত মস্তকে মেনে না নিয়ে, তাকে/তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করা, প্রতিবাদ করার অনিবার্য খেসারত হচ্ছে এরকম পরিনতি।
ঐ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আপোষ না করে "সম্মানিত হুজুরকে" কারাগারে নেওয়াকে ঐ অধ্যক্ষের অন্ধ অনুগত দাসগুলো "অমার্জনীয় অপরাধ" হিসেবে গন্য করেছে। তারা আরও মনে করেছে এর মাধ্যমে সমগ্র আলেম সমাজকে হেয় করা হয়েছে। তাই নুসরাতকে সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে হবে।
অন্য দিকে ঐ মাদ্রাসার কিছু শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রী, যাদের রয়েছে ক্ষমতাবান হুজুরের প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও দায়, তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে "পরম শ্রদ্ধেয়" হুজুরের অসম্মানে ও তাদের গর্বের, গৌরবের প্রতিষ্ঠানের (মাদ্রাসার) "ভাবমূর্তি " ক্ষুন্ন হওয়ার কারনে।
এই ব্যক্তি পূজা ও প্রতিষ্ঠান পূজার উদাহরণ কিন্তু সর্বত্র। সম্প্রতি কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ও ছাত্রী যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে।
ছাত্র ছাত্রীদের আন্দোলনের চাপে ও মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার কারনে, ভার্সিটির কতৃপক্ষ তাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত ও নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি গঠন করে।
তবে কর্তৃপক্ষ এবং তাদের কিছু সহকর্মী তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত "ভাবমূর্তি " রক্ষায় নানান রকমের ছলচাতুরী, বাহানার আশ্রয় ও নিয়ে থাকে। তাদের কাছে ও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষা মূখ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়।
অথচ এরকম অপকর্মই যে ভাবমূর্তি হারানোর মূল কারণ এবং এর যথাযথ শাস্তি প্রদানই যে, সে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের একমাত্র পথ, এই উচ্চ শিক্ষিত মানুষ গুলো ও সেটি ভুলে যায়।
২য়ত শামীম নামক ছেলেটি নুসরাতকে বার বার প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়।অথচ সে স্হানীয় ভাবে শক্তিশালী।
নুরউদ্দীন,শামিমরা হচ্ছে ঐ অধ্যক্ষের লাঠিয়াল বাহিনী। এর আগে ও প্রত্যাখ্যানের জন্য নুসরাতকে অপদস্ত করা হয়েছিল। তাকে চুনকালি মেখে আহত করে। এতে তাকে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়।
ঐসব অপরাধ করে ও তারা ঐ খুটির জোরে পার পেয়ে যায়।অপরাধের শাস্তি না হওয়াতে এরা আরো উদ্ধত, বেপরোয়া হয়ে উঠে।
শামীম এবার তার প্রেম প্রত্যাখ্যানের শোধ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।গোপন মিটিংয়ে নুসরাতকে কিভাবে মারবে তার পথ বাতলাতে শামীমই প্রস্তাব করে, আগুনে পুড়িয়ে মারার কথা।
জিঘাংসা কতো নির্মম, কুৎসিত হলে মানুষ এতো জগন্য প্রস্তাব করতে পারে?
৩য়ত ঐ হুজুরের বিরুদ্ধে আগে ও এরকম অনেক অনৈতিক, অপরাধের অভিযোগ ছিল। যারা প্রতিবাদ করেছে বরং তাদেরকে সে শোকজ নোটিশ পাঠায়।
স্হানীয় পর্ষদ, পুলিশ কেউ ঐসব অপরাধের বিচারে ভূমিকা নেয়নি। এভাবে বিচারহীনতার কারনে অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধি পায়।হুজুর ও নিজেকে সবকিছুর ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করেছে।
তানাহলে সে এতো উদ্ধত হয়ে নুরউদ্দীনকে বলতো না তোরা আমার জন্য কি করলি?। এর মাধ্যমে সে তার মাস্তান বাহিনীকে একশনে যেতে ইঙ্গিত দেয়।
এর পরিনতি কি হবে তা ভাবেনি।বরং ভেবেছে আগের মতনই সব ম্যানেজ করে ফেলবে।
৪র্থ বিষয়টি হচ্ছে সব অপরাধের মূল কারণ।
মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে
১। ব্যক্তিত্বের আদিম স্তর "ইদ" (id) কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে।
সকল লোভ,লালসা,কামনা বাসনা তাৎক্ষনিক ও যেকোন উপায়ে চরিতার্থ করতে চায় ইদ।ইদের চাহিদা যাদের বেশি, তারা অপরাধে জড়িয়ে পরে সহজে।
ছোট কালে পরিবার থেকে সুশিক্ষা পেলে, ইদের লাগামহীন চাহিদার মাত্রা কমে আছে। কিন্তু কয়টি পরিবারে সে সংযম,ধৈর্য শিক্ষার পরিবেশ রয়েছে ও তাৎক্ষণিক তৃপ্তি মেটানোর দাবীকে অগ্রাহ্য করার শিক্ষা দেওয়া হয়?
২। ইগো-যদি দুর্বল হয় তাহলেও মানুষ অপরাধ প্রবন হবে।
ইগোর কাজ হচ্ছে ইদের অনৈতিক চাহিদাকে বাস্তব সম্মত করা বা নিয়ন্ত্রণে রাখা। ইগো দুর্বল হলে তাই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পরে।
ইগো নিয়ন্ত্রণে থাকে আইনের ভয়ে, সমাজের ভয়ে বা ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে।
কিন্তু আইনের শাসন, সুবিচার কিংবা সামাজিক ন্যায্যতা কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? ।
৩। সুপার ইগো বা বিবেকঃ বিবেক ভালো ভাবে গড়ে না উঠলে বা পরবর্তীতে বিবেক মরে গেলে, মানুষ আর মানুষ থাকে না।তখন সে দানবের মতন,পশুর মতন পাপ কার্য করে বেড়ায়।
প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের নৈতিকতা, মূল্যবোধের অবস্থান কোথায়? সার্বিকভাবে দেশে,সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে এটি এখন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে যারা নৈতিকতা শেখাবেন তারা নিজেরাই নৈতিক অধপতনের চূড়ান্ত সীমায়।
কোথায় নৈতিকতা শিখবেন?
পরিবারে? আমরা কি নিজেরা তেমন উত্তম "রোল মডেল "?
শিক্ষালয়ে? যেখানে উপরের নির্দেশে পাশের হার ও জিপিএ -৫ এর হার গনহারে বাড়িয়ে দেয় শিক্ষকরা-সেখান থেকে?
সর্বশেষ আশ্রয় স্হল হলো ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসা যাকে আমরা নিছক প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাবি না,যাকে ভাবা হয় নৈতিকতা ও আদর্শবাদিতা শেখার মূল কেন্দ্র, সেখানে ও ঘটছে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনা (সব মাদ্রাসা বা হুজুরকে ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা ঠিক না)।
যে হুজুর তার ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অন্যায়,অপকর্ম থেকে বিরত থাকার নৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শের বীজ রোপণ করবেন, সে কি করে পরীক্ষার প্রশ্ন পত্র পাইয়ে দেওয়ার মতন অনৈতিক প্রস্তাব করতে পারেন?
তদুপরি তিনি সেটি স্নেহবশত করলে ও অনৈতিক হতো, কিন্তু তিনি সেটি করেছেন অত্যন্ত জগন্য একটি পাপাচারের প্রস্তাব দিয়ে।
ইসলাম ধর্মে এরকম গর্হিত পাপাচারের শাস্তি কত ভয়ঙ্কর, মাদ্রাসার আলেম হিসেবে ওনার এটি ভালো জানার কথা।
৫মত পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলেছে। পুলিশ শুধু উর্ধতনদের আদেশ পালন করে তা নয়,স্হানীয় পর্যায়ে যে নেক্সাস, এর অন্যতম অনুঘটক থাকে কিছু সংখ্যক পুলিশ।
ক্ষমতাশালী নেতৃত্ব যে বলয় তৈরি করে, তাদের ইচ্ছে পূরনে তারা বাধ্য থাকে বা নিজ স্বার্থে একজোট হয়ে কাজ করে।
সার্বিক ভাবে বললে নৈতিক, মানবিক সমাজ নির্মাণে আমাদের ব্যর্থতা এবং রাস্ট্রীয় ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি
একটি নষ্ট, পচনশীল, অধপতিত পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
আমাদের সমাজ ক্রমশ সেই অন্ধকার, পিচ্ছিল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে।
মহাবিশ্বে কৃষ্ণ গহ্বর যেমন সবকিছু গ্রাস করে নেয়, এমনকি আলো পর্যন্ত সেখান থেকে ফিরে আসতে পারে না। তেমনি আমরা ও মনে হচ্ছে তেমন এক রাহুগ্রাসের কবলে পড়ে, ক্রমশ কৃষ্ণ গহ্বরে চিরতরে তলিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছি।
এই অধপতন ও তলিয়ে যাওয়া রোধ করার কোন উপায় কি নেই? কারা ঠেকাবে কৃষ্ণ গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার তীব্র পিছু টানকে?