রোগ কাহিনী:১২
"আমি মরা,আমি মরা"
রোগীনি আলেয়া,বয়স ৫০। রোগের ইতিহাস ৩ মাসের।
তিনি বলেন পা থেকে শির শির উঠে,
ঘুম আসে না,
আমরা দীল নাই,মন নাই,
আত্মা নিয়ে গেছে,
কলজা-ফেপসা রুহু সব নিয়ে গেছে।
চক্ষু নাই,নিঃশ্বাস নাই-
আমি মরা সব মরা।
অস্হির,খাওয়া - দাওয়া করে না
সারাক্ষণ চিৎকার করে আমি মরা,আমি মরা।
পানি ও খায় না বলে পেট,নাড়ী সব মরা খাবো কি ভাবে?
শুধু মুখ ও কথা ছাড়া সব নিয়ে গেছে,শেষ হয়ে গেছে,পচে গেছে
কে নিয়ে গেছে জিজ্ঞেস করলে বলে, আল্লাহ নিয়ে গেছে,খারাপ জিনিসে নিয়ে গেছে।
আনন্দ নেই,অশান্তি, হাহুতাশ
কান্না কাটি করে,
বলে আমারে মেরে ফেলো
বটি দিয়ে গলাতে পোচ দেয়,মরে যাবে
( দু' বার এ রকম আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে)
সারাক্ষণ হাহাকার
আমি মরা আমি মরা
কাপড় চোপর সব খুলে দেখাতে চায়
সব পচা,সব মরা
দিন রাত ২৪ ঘন্টা আহাজারি করে -
আমি মরা আমি মরা
.............................
এ কেইস থেকে আমরা যা জানলাম:
১। এটি এক ধরনের গভীর বিষন্নতা রোগ( মেজর ডিপ্রেশন)
২। ডিপ্রেশন অনেক রকমের হয়-
এটি হচ্ছে সাইকোটিক ডিপ্রেশন, যেখানে হ্যালুসিলেশন,ডেলুসন থাকে
৩। এ রোগীর নিহিলেস্টিক ডেলুশন রয়েছে।
নিহেলিজম হচ্ছে " অস্তিত্বহীনতা"( নন একজিসটেন্স)।
এটিকে " কোটার্ড সিনড্রোম ও বলা হয়।
৪। গভীর ডিপ্রেশনে রোগী নিজকে ছোট,হেয়,ক্ষুদ্র মনে করে।
তার কিছুই নাই-
কোন যোগ্যতা নাই,গুন নাই,
সহায়- সম্পদ নাই,
তিনি নিঃস্ব,অসহায় ইত্যাদি।
এভাবে নিজের কিছু নাই হতে হতে, এক সময় মনে হয় নিজেই নাই-
তার মস্তিস্ক পচে গেছে,পেট নাড়ী ভুরি মরে গেছে
আরো গভীরতায় গিয়ে মনে হয়, তার পুরো অস্তিত্বই নাই হয়ে গেছে
তিনি মারা গেছেন,তিনি এখন লাশ
( মিটফোর্ড হাসপাতালে কাজ করার সময় এক হিন্দু মধ্য বয়স্ক লোক ভর্তি হয়েছিল।সে ও নিজকে পুরো মৃত মনে করতো।তার লাশ চিতায় রয়েছে,আমরা তার প্রেতাত্মাকে এখানে এনে রেখেছি)
৫। সাইকোটিক ডিপ্রেশন এর রোগীকে যুগপৎ এন্টি সাইকোটিক ও এন্টি ডিপ্রেশন্ট ঔষধ, ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়।
এ ধরনের রোগী ইসিটি ( ইলেকট্রো কনভালসিভ থেরাপি) দিয়ে ও ভালো ফল পাওয়া যায়।
এ রোগীনিকে ও ইনজেকশন,ঔষধ দেওয়ার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ভালো ফল পাওয়া যায়।
তিনি আরোগ্য লাভের পথে আছেন
রোগ কাহিনী-১৩:
"হুজুর হয়ে ঢুকে পরে বিড়াল হয়ে যায় "
মার্জিনা বয়স ৪০।
গত ১০ বছর যাবত এ রোগে ভুগছে।
তার ভাগনীর ও এ রোগ ছিল।
ভাগনী জিকির করতো -আল্লাহ আল্লাহ।
তিনি বলেন এটি দেখে আমার ভিতর ও জিকির ঠেলে উঠতো।
ভাগনী এক সময় বলে হুজুর বলেছে এ রুমে কেউ থাকতে পারবে না,থাকলে সমস্যা হবে।
আমার নিজের ঘর থেকে আমাকে চলে যেতে বলে।
আমি রাগ করে তাকেই তাড়িয়ে দেই।
এর মধ্যে মেয়ের ভিতর ও জিকির উঠা শুরু করে।
মেয়ে বলে এক লোক হুজুর হয়ে ঘরে ঢুকে, পরে বিড়াল হয়ে যায়।
এটি শুনে আমার খুব ভয় লাগে,
সারা রাত ঘুম হয় না।
কেবল হাহুতাশ করতে লাগলাম।
এরপর থেকে আমিও দেখি হুজুর হয়ে ঢুকে বিড়াল হয়ে যায়।
মেয়ে প্রায়ই ফিট হয়ে যায়।
মেয়ে বাড়ীর এ পাশ থেকে ও পাশে উড়ে উড়ে যায়।
মেয়ে বলে বাতাস তাকে টেনে নিয়ে যায়।
মেয়ে দেখে এক কঙ্কাল,
যার চোখ বড় বড়,মাথা নাই,
বড় বড় নখ,
হাড্ডি ছাড়া কোন গোস্ত নেই।
ঐ কঙ্কাল মেয়েকে খামচিয়ে রক্ত বের করে ফেলে,যা আমরা সবাই দেখেছি।
১০ বছর ধরে তারা মা, মেয়ে এই যন্ত্রণার ভিতর আছে,
যদিও ঐ ভাগনী পরে ভালো হয়ে যায়।
পীর ফকির,কবিরাজী অনেক চিকিৎসা হয়েছে কিন্তু তারা ভালো হতে পারেনি।
৩-৪ টি সেশন দেওয়ার পর মা প্রায় রোগ মুক্তির পথে।
তিনি কথা দিয়েছেন মেয়েকে ও চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসবেন।
এ রোগ কাহিনী থেকে আমরা যে সব শিখলাম:
১। এ ধরনের তথাকথিত জ্বীনে ভূতে ধরা রোগী মূলত এক রকমের " মানসিক রোগী" তথা ব্রেইনের রোগী।
যাকে " ডিসোসিয়েটিভ কনভার্সন ডিসঅর্ডার " বলা হয়।( হিস্টিরিয়া)
২। হিপনোসিস,মেডিটেশন এ " সাজেশন " এর রয়েছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
নিছক সাজেশন দিয়ে যা করতে বলা হয় ব্যক্তি তাই করে।
হিস্টিরিয়া রোগীরাও খুব সাজেস্টবল।
৩। প্রায়ই আমরা যে শুনি কোন এক স্কুলে একজন মেয়ে ফিট হয়ে পড়েছে তো এটি দেখে একের পর এক অন্য মেয়েরা ও ফিট হতে থাকে।
এরপর এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশেই বিভিন্ন স্কুলের মেয়েরা নিছক শুনেই ঐ রোগে আক্রান্ত হয়।
যাকে আমরা " মাস হিস্টিরিয়া" বলি।
৪। মানুষের মন ও ব্রেইনকে খুব সহজে ও দ্রুত " প্রভাবিত" করা যায়।
সাজেশন দিয়ে তেমনটি করা হয়।
নিছক শুধু " দেখে" বা " শুনে" ও অনেক ঝুকিপূর্ন ব্যক্তি( ভারনারেবল) এ রকম " অনুকরণ " করে থাকে, যা রীতিমত অবিশ্বাস্য।
৫। মনে রাখবেন তথাকথিত জ্বীনে ভূতে ধরা সব রোগী মূলত মানসিক রোগী।
অহেতুক অপচিকিৎসা না করে সরাসরি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এর কাছে নিয়ে যান
( আমি প্রথম সাইকিয়াট্রিস্ট যিনি বহু আগ থেকে প্রেসক্রিপশন প্যাডে " জ্বীন ভূতে ধরা" চিকিৎসা করি কথাটি লিখেছি।
অনেকে এসে জানতে চায় আমি তেমন পারি কিনা।
আমি জোরের সঙ্গে বলি যে কোন জ্বীন হুজুরের চেয়ে ভালো পারবো,রোগী আনেন।
কেননা আপনারা যাকে জ্বীন ভূত ধরা মনে করছেন তা ব্রেইনের রোগ)
৬। বর্তমানে অনেক পীর ফকির,কবিরাজরা ও জ্বীনে ধরা রোগী মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়ে দেন।
তবে প্রথমে নিজেরা চিকিৎসা দেয় ও বলে জ্বীন তাড়িয়ে দিয়েছি, সামান্য সমস্যা রয়েছে সেটি ব্রেইনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করেন।
এটি তবুও মন্দের ভালো
( মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে এ গুলো মনের বা ব্রেইনের রোগ)
No comments:
Post a Comment