Monday, May 28, 2018

সাইকোলজি ডিসঅর্ডার সিরিজ ( পিডিএস):মাদকাসক্তি

পর্ব-২: মাদকাসক্তির ব্রেইন মেকানিজম

( আমার " মাদকাসক্তি :একটি নিরাময়যোগ্য ব্রেইনের রোগ" এ আসক্তির ব্রেইন মেকানিজম নিয়ে একাধিক অধ্যায় রয়েছে
সে সব থেকে চুম্বক কয়েকটি কথা জানাবো)

সংক্ষিপ্ত ব্রেইন মেকানিজম :

পর্ব-১ এ বলেছি মাদক দ্রব্য ব্রেইনে গঠনগত পরিবর্তন সাধন করে বলে মাদক নেওয়া রোগীর জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে দাড়ায়।
ব্রেইন নিজেই আসক্ত হয়ে পড়ে( addictive brain)

ব্রেইনের এ পরিবর্তন গুলোর জন্য তাদের মধ্যে বিশেষ কিছু আচরন পদ্ধতি গড়ে উঠে;
তাদের মন- মেজাজে পরিবর্তন আসে;
আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দেয়;
বিবেক- বিচার বোধ  ভোতা হয়ে যায়;
সিদ্ধান্ত গ্রহন, দায়িত্ব পালনে অপারগতা দেখা দেয়- ইত্যাদি।

মনে রাখা ভালো আমাদের শরীরে/ ব্রেইনে প্রাকৃতিক ভাবে মাদক সদৃশ রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে।
এগুলোকে বলা হয়- endogenous addictive neurone transmitter।
যেমন: হিরোইন  আফিম জাতীয়  সমগোষ্ঠীর দ্রব্য -এন্ডোরফিন ও এনকাফিলিন থাকে ব্রেইনে; গাজার সমতুল্য রয়েছে-এনানডামাইড।

বাইরের হেরোইন,গাজা যে রকম মনকে আনন্দ, তৃপ্তি দিয়ে থাকে,
ব্রেইনের নিজস্ব এসব দ্রব্য ও তেমন কাজ করে থাকে।

(অবাক হচ্ছেন যে স্রষ্টা ব্রেইনে মাদক রেখে দিয়েছে?তবে এগুলো ভালো অনুভূতির জন্য এবং এগুলোর অপব্যবহার করতে পারবেন না)।

কিন্তু  ব্রেইনের নিজস্ব এসব বার্তাবাহকের তুলনায়, বাহির থেকে গ্রহন করা " মাদকের" আকর্ষণ  ক্ষমতা অনেক বেশি।

বাইরের আফিম,হিরোইন, ইয়াবা ব্রেইনের এসব আভ্যন্তরীণ  বার্তা বাহক সিস্টেমকে
রীতিমত " হাইজ্যাক" করে ফেলে।এভাবে স্বাভাবিক আনন্দ -পুরস্কার তন্ত্র, ঐসব মাদকের কাছে " জিম্মি" হয়ে যাওয়াতে,
মাদকাসক্তরা জীবন থেকে সাধারন আনন্দ স্ফূর্তি আর নিতে পারে না।
আনন্দ স্ফূর্তি ও চাঙ্গা ভাবের জন্য তারা ঐ বাহির থেকে গ্রহন করা " মাদকের" উপর পূর্নভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

এক কথায় ব্রেইন- মনের " hedonic capacity " ( আনন্দ সুখ অনুভব ক্ষমতা) নষ্ট হয়ে যায়

।সর্বশেষ তত্বে এ মতকে বেশি সমর্থন করা হয় যে,
মাদকাসক্তির প্রধান কারন নিছক আনন্দ খোজা নয়,
বরং হারানো আনন্দ ( মাদকের কারনে হারানো) কৃত্রিম ভাবে ফিরে পেতে তারা বার বার তারা মাদকের দিকে ফিরে যায়।

তবে আনন্দ -পুরস্কার পাওয়া ও নেওয়াটি ও গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের ব্রেইনে এরকম একটি তন্ত্র রয়েছে যার
নাম - Reward system বা " পুরস্কার /আনন্দ তন্ত্র ।
এ সিস্টেমটির বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে-Mesolimbic- dopaminergic system ।

সব মাদক দ্রবই ( ঘুমের ঔষধ - বেনজোডায়াজেপিন ছাড়া) এই ডোপামিন তন্ত্রকে  উজ্জীবিত/সক্রিয় করে।

ক্ষিধা পেলে খাদ্য যে তৃপ্তি দেয়,পিপাসায় পানি যে তৃপ্তি  দেয় তা এই মেসোলিম্বিক ডোপামিন তন্ত্রের জন্যই।
ঠিক একই রকমের চাহিদা,তৃপ্তি পূরন করে ঐ সব মাদক।

বরং প্রাকৃতিক এসব চাহিদার চেয়ে( খাওয়া,যৌনতা) মাদকের আকর্ষণ / প্রলোভন আরো বেশি মাত্রার হয়ে থাকে।

ইদুরকে কোকেন দিয়ে দেখা গেছে এরা নিত্য দিনের খাবার বাদ রেখে শুধু মাত্র ঐ মাদক গ্রহনে ব্যস্ত থাকে
ও এভাবে না খেয়ে এদের অনেকে মারা যায়

।মাদক এমনি শক্তিশালী ইনসেন্টিভ যা অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় নাওয়া-খাওয়া ও ভুলিয়ে দেয়

(এই  রিওয়ার্ড সিস্টেমে রয়েছে : NAc( nucleus accumbens); Ventral tegmental area(VTA);Pfc(( pre- frontal cortex); Amygdala;bed nucleus of striaterminalis( BNST)।)

খটমটে ও জটিল প্রক্রিয়া গুলোর বর্ননা না  দিয়েও সহজভাবে বলি-

প্রায় সব মাদক( বেনজোডায়াজেপিন ছাড়া) NAc অন্চলে ডোপামিনের পরিমান বাড়িয়ে দেয়

।এ অন্চলের ডোপামিন রিসিপ্টরগুলো মাদক দ্রব্যের প্রধান ও মূল বল বৃদ্ধিকরনের ( re-enforcement) কাজটি করে থাকে।

ডোপামিন হচ্ছে সে দ্রব্য যা ঐ পুরস্কার তন্ত্রের বাহক এবং যা ইতিবাচক জিনিস দিয়ে উদ্দিপ্ত হয়।
যেমন - খাদ্য, পানীয়, যৌনতা।এগুলো হচ্ছে প্রাকৃতিক পুরস্কার আর মাদক হচ্ছে কৃত্রিম তবে এরচেয়ে ও শক্তিশালী  পুরস্কার বা বখশিশ।

এ জন্য নেশা গভীর পর্যায়ে গেলে সব ধরনের প্রাকৃতিক পুরস্কার বা তৃপ্তির ব্যাপার গুলো দমিত হয়ে যায়।
ফলে ব্রেইন স্বাভাবিক জীবন থেকে সুখ,তৃপ্তি,শক্তি অর্জন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

এ জন্য তার আনন্দ, সুখ,শক্তিমত্বা,চাঙ্গাবোধের এক মাত্র উৎস হয়ে দাড়ায় ঐ মাদক।

তাই মাদক ছাড়া তার জীবন হয়ে পড়ে অচল।

শত ঔষধ, থেরাপি, উপদেশ তার ঐ অক্ষমতা,অচলায়তন সহজে আরোগ্য করতে   পারে না।
অথচ নিমিষে মাত্র ১ ডোজ মাদক তাকে ঐ হারানো শক্তি,আনন্দ, উচ্ছলতা ফিরিয়ে দিতে পারে
( যদিওবা তা সাময়িক এবং যে মাদক তার এই পঙ্গুত্বের জন্য দায়ী সেটি বার বার নেবার ফলে প্রতিবারই তার ঐ অক্ষমতা আরো বাড়তে থাকে)।

মাদকাসক্তির কারন গুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করছি:

১।মন- ব্রেইনের পুরস্কার /আনন্দ তন্ত্রের বল- বৃদ্ধি হওয়া--

মাদক ডোপামিন রিলিজ করে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। রোগীরা এরকম অনুভুতিকে বর্ননা করেন - এক অলীক আনন্দ শিহরনের সঙ্গে

।একে বলা হয় Rush বা high।
মাদক গ্রহনের অন্যতম কারন এই "রাস বা হাই ভাব" পাওয়া।

এটি হচ্ছে -" তৃপ্তিদায়ক পর্যায় ( consummatory phase)  ।

২। মাদক শুধু আনন্দ দেয় না- এ শরীর মনের উদ্বেগ, যাতনা,ব্যথা কমিয়ে দেয়।এ কারনেও মাদক আকর্ষনীয়।

৩। পারিপার্শ্বিক উপাদান গুলোর সঙ্গে মাদক গ্রহনের একটি "যোগসূত্র " তৈরী হয়ে যায়।

যাকে " "কন্ডিশনিং"-বলা হয়।
অর্থ্যাত যে বন্ধুরা,যে জায়গাগুলো,যে অনুসঙ্গ গুলো,যে আবেগ-অনুভুতিগুলো মাদক গ্রহনের সঙ্গে যুক্ত, সেগুলো মাদকের "আনন্দ -সুখের" সঙ্গে সংশ্লিষ্ট  হয়ে পড়ে।

যে কারনে সেগুলো নিজেরাই পরবর্তীতে মাদকের " আকর্ষণ /টান" তৈরী করে।
ফলে এদের প্রভাবে সে পুনরায় মাদক গ্রহন করে ফেলে।

৪।ক্ষুধা বর্দ্ধক পর্যায়টি অতি সংবেদনশীল হয়ে পড়া( Sensitization of appetitive phase) :

   কাউকে তার প্রিয় বিরানি ৩ বেলা সপ্তাহ খানেক খেতে দিলে বিরানির প্রতি অরুচি তৈরি হবে

।প্রাকৃতিক সকল আবেগ,আকর্ষণ এভাবে ক্রমশ কমে আসে।

( প্রেম- বিয়ের রোমান্স ও এভাবে দিনে দিনে থিতিয়ে আসে)।

কিন্তু  মাদক উল্টো ব্রেইনের এই ক্ষুধাবর্দ্ধক পর্যায়কে  ক্রমশ আরো সংবেদনশীল করে তোলে।

ফলে যতদিন যায় মাদক তাদের কাছে আরো আকর্ষনীয়,আরো লোভনীয় হয়ে দাড়ায়।
যত খায় তত আরো লোভনীয় মনে হয়( লোভনীয় খাবার পেলে আপনি কি করবেন?)

৫।অন্য দিকে "তৃপ্তি পর্যায়টি"(consummatory phase)  ভোতা হতে থাকে।

মাদক নেওয়ার পর প্রথম দিকে যে তৃপ্তি পেতো , দিনকে দিন সে তৃপ্তির মাত্রা কমতে থাকে।

ব্রেইনে মাদকের প্রতি " সহনশীলতা " বেড়ে যাওয়াতে( টলারেন্স) 
একই মাত্রার মাদক আগের পরিমাণে তৃপ্তি দিতে পারে না।
তাই ক্রমাগত মাদকের পরিমান বাড়িয়ে নিতে হয়।

একদিকে মাদকের ক্ষুধা বাড়ে,অন্য দিকে যতটুকু নেয় তা তৃপ্ত করে না--
তাহলে সে হন্য হয়ে মাদকের পিছনে ছুটবে,সেটি কি অস্বাভাবিক?

৬।বোনাস( ইনসেন্টিভ) :

মাদক "পুরস্কার " তন্ত্রে  " বোনাস" হিসেবে (incentives) কাজ করে।

বোনাস মানে বাড়তি আনন্দ, বাড়তি সুযোর,বাড়তি সম্মান,স্বাধীনতা।
ব্রেইন তাই মাদকের বোনাস পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে( আমরা যেমন ঈদের বোনাসের অপেক্ষায় থাকি)।
রেগুলার মানসিক বোনাস পাওয়ার লোভ কতজন সামলাতে পারে?

৭। উইথড্রল সিমপ্টমস-
মাদক প্রত্যাহার জনিত কষ্টকর লক্ষণ সমূহ:

মাদক ছেড়ে দেওয়া মুখের কথা নয়( দুই দিন সিগারেট ছেড়ে দেখুন)।

মাদক না নিলে যে তীব্র যন্ত্রণা,কষ্ট তৈরি হয় তা যে  কত ভয়ঙ্কর সেটি একমাত্র  ভুক্তভোগী ও তার কাছের লোকেরা জানে।

বহু চেষ্টা করেও তারা কেন মাদকে বার বার ফিরে যায় তার অন্যতম কারন এটি।

৮।স্বাভাবিক আনন্দ, সুখ হারিয়ে যাওয়া(reduced hedonic capacity) :

আগেই উল্লেখ করেছি নেশা ব্রেইনের আনন্দ সুখ অনুভবের ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে।

আনন্দ পাওয়ার চেয়ে পরবর্তীতে স্বাভাবিক জীবন থেকে আনন্দ, তৃপ্তি, সুখ, না পাওয়ার কারনে মাদকাসক্তিরা কৃত্রিম আনন্দ, তৃপ্তি ও শক্তি পেতে মাদক নিতে বাধ্য হয়।

তখন এটি তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাড়ায়

৯।অপ্রত্যাশিত পুরস্কার /আনন্দের সংবাদ:

আমরা যখন অপ্রত্যাশিত কোন আনন্দ সংবাদ শুনি বা অভাবিত কোন ভালো জিনিষ পেয়ে যাই

, তখন ব্রেইনের NAc অন্চলে ডোপামিনের নিঃসরন হয়।
মাদকাসক্তদের বেলায়ও অনেকদিন নেশা গ্রহন না করলে  হঠাৎ কোথাও সে " বহু কাঙ্খিত" মাদক প্রাপ্তির সম্ভাবনার ঝিলিক দেখা দিলে,

তাদের ব্রেইনেও ডোপামিন নিঃসরিত হয়।
বাধ ভাঙ্গা প্রবল স্রোতের মতন ডোপামিন নিঃসরিত হতে থাকে।

তখন মাদক ত্যাগের তাদের সকল সংকল্প, প্রতিজ্ঞা ও শুভ ইচ্ছা মুহূর্তে  ভেসে যায়।তারা তখন আকন্ঠ নেশায় ডুবে যেতে চায়

১০। মানসিক চাপ,নেতিবাচক অনুভুতি,অন্তঃদন্ধ  মাদকের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে

১২। বিশেষ দিন,উৎসব একইভাবে মাদক নেশাকে চাঙ্গা করে( থার্টি ফার্স্ট ডে,ঈদ,নববর্ষ...)

১৩। হাইপোফ্রন্টালিটি:

আগেই বলেছি Pfc  অন্চলের কথা-
নেশা বাড়তে থাকলে এ অন্চলের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে।

প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স হচ্ছে মানুষের " মানুষ " হয়ে উঠার প্রধান কারন।
বুদ্ধি, বিবেক,বিবেচনা, নৈতিকতা, সুশীলতা,মানবিকতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্ম সংযম, সিদ্ধান্ত গ্রহন - ইত্যাদির কেন্দ্র এটি।

স্বাভাবিক ভাবেই এর কার্যক্ষমতা কমে গেলে :
আবেগ তাড়িত,ঝোকের মাথায় কাজ করার প্রবনতা  বৃদ্ধি পায়( হঠাৎ ক্ষিপ্ত হওয়া,আঘাত করা,খুন করা) ;

সুবিবেচনা প্রসূত চিম্তা ও কাজ করতে অক্ষম থাকে;
সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন সম্ভব হয় না।

এসব কারনে লজিক খাটয়ে,ধ্যৈর্য ধরে আবেগ,তাড়না নিয়ন্ত্রণ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

১৪।নতুন ক্ষতিকর আচরন সৃষ্টি :

VTA  এর ডোপামিন স্নায়ুকোষ গুলো
অতিরিক্ত " সেনসিটাইজড" হয়ে যায়।

ফলে মাদকের বোনাস পুরস্কার পাওয়ার জন্য রোগী অনেকগুলো আচরন,দক্ষতা অর্জন করে

।কিভাবে কত নিপুনভাবে মাদক সংগ্রহ, কেনা ও গ্রহন করতে হবে তারা সেসব দক্ষতা ভালোভাবে আয়ত্ব করে।
বিনিময়ে ভালো আচরন ও দক্ষতা কমে যায়।

তাই মাদক ছাড়তে যত অপারগ, মাদক নিতে তত পারঙ্গম হয়।

১৫।CREB( cAMP response element binding protein):

এটি মাদকের পুরস্কার ও বোনাস প্রাপ্তির আগ্রহ ও আকর্ষনকে বাড়িয়ে দেয়।

এ বাড়তি আকর্ষনের জন্য রোগীর মধ্য কিছু শিক্ষন( ইনসেন্টিভ লার্নিং)  অর্জিত হয়।

মাদকের বোনাস ক্ষমতাকে উচু মাত্রায় নিয়ে যায় বলে মাদক আরো লোভনীয়, আকর্ষনীয় হয়ে উঠে।

যেন রূপসী পরি হাতছানি দিয়ে ঢাকছে।মাদকের আকর্ষন হয়ে উঠে দুর্বার ও অপ্রতিরোধ্য।

ঐ " বেহেস্তী ফল" পেতে তখন তারা আরো দক্ষ হয়ে উঠে।
সে আচরন তখন বদলানো কঠিন।

১৬। স্মৃতি সংবেদনশীলতা : 

যতই দিন যায় আমাদের স্মৃতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে যায়।

কিন্তু মাদক সংক্রান্ত স্মৃতিগুলো দুর্বল না হয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে।
এ ক্ষেত্রে " এমাগডেলার" ভূমিকা রয়েছে।

এই উজ্জ্বল, জ্বল জ্বলে স্মৃতিগুলোই যথেষ্ট মাদক বর্জন করার পরও রোগীর মধ্য মাদকের " টান" সৃষ্টি করতে
  
## সব মিলিয়ে " আসক্ত ব্রেইনই" যথেষ্ট  বার বার মাদকের দিকে টেনে নিতে(অন্যদের প্ররোচনার তেমন দরকার পড়ে না)

## তাই ক) কেন তারা মাদক সহজে ছাড়তে পারে না
খ) কেন চিকিৎসায় সহজে ফল পাওয়া যায় না

গ) কেন দীর্ঘ স্হায়ী ও বহুমুখী সমন্বিত চিকিৎসার প্রয়োজন - নিশ্চয় আপনাদের বুঝে আসবে

Sunday, May 27, 2018

সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল -২৪: মাদকের বিরুদ্ধে - চলো যাই যুদ্ধে

সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে আলোচনা চলছিল। অনেকের অনুরোধে গুরুত্বপূর্ণ মানসিক রোগগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার চিন্তা করছি।

সিরিজের নাম হবে : সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার সিরিজ( pds)

আজ শুরু করছি-- মাদকাসক্তি দিয়ে

( কেননা দেশ ব্যাপী চলছে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান /যুদ্ধ)

## আমি মাদকাসক্তির উপর ২টি বই লিখেছি

১। মাদকাসক্তি : একটি নিরাময়যোগ্য ব্রেইনের রোগ- কারন,চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়( এডর্ন- ২০১০সাল)।

এটি দীর্ঘ ৬০০ পৃষ্ঠার বই ছিল।প্রকাশক ফন্ট ছোট করে ও অন্যান্য কারুকাজ করে সাড়ে চার শ পৃষ্ঠায় নামাতে পেরেছে।

এটি মাদকাসক্তির এ-টু- জেড,সব কিছু একত্রে পাওয়ার একটি বই- এমনকি গবেষক, পোস্ট গ্রাজুয়েট সাইকিয়াট্রি/ সাইকোলজিস্টদের জন্য ও

২। মাদকাসক্তির চিকিৎসা সমগ্র - ছোট বই তবে সকল প্রকার চিকিৎসার নির্যাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি

## প্রথম বই থেকে চুম্বক কিছু ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরবো

আজ- পর্ব-১: মাদক নির্ভরশীলতা ও ব্রেইন মেকানিজম

নির্ভরশীলতা ( drug dependency) :

বইয়ের নামই দিয়েছি - মাদকাসক্তি একটি ব্রেইনের রোগ।কেননা প্রথমে স্বইচ্ছায় ড্রাগ নিলেও,পরবর্তীতে এটি নেওয়া,না নেওয়া ব্যক্তির ইচ্ছাধীন থাকে না।এটি গ্রহন তার জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে দাড়ায়।

এরকম হওয়ার কারন মাদক তার ব্রেইনে কিছু গঠনগত পরিবর্তন সাধন করে।( পরে তা জানবো)

কিভাবে বুঝবো কেউ মাদকে আসক্ত/ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন কিনা?

১।ক্রমাগত ভাবে মাদকের ডোজ বাড়াতে থাকে।আগের মাত্রায় খেলে আগের মতন আনন্দ পায় না বা আগের সমান ক্রিয়া পায় না,তাই ডোজ বাড়াতে হয়।একে বলা হয়- টলারেন্স ( সহনশীলতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া)

২। মাদক ত্যাগ বা ডোজ কমালে তীব্র প্রত্যাহার জনিত শারিরীক কষ্টকর উপসর্গের সৃষ্টি হয়( উইথড্রল সিম্পটম- তারা বল "বেড়া")

৩। দীর্ঘ দিন ধরে অভ্যাস চালিয়ে যাওয়া ( ক্ষতিকর জেনেও)

৪। ছেড়ে দেওয়ার পরও  মাদকের জন্য তীব্র আকর্ষণ  থাকা( ২ ও ৪ নং এর জন্য তারা বার বার ও পুনরায় মাদক গ্রহন করে থাকে)

৫।দিনের বেশীরভাগ সময় মাদক সংগ্রহ ( এটি পেতে হলে নির্দিস্ট জায়গা বা মানুষ লাগে);

কেনার জন্য টাকা সংগ্রহ ( মাদক দামী,তাই প্রতিদিন অনেক টাকা হাতে থাকতে হয়,ফলে জোর করে,ধান্ধা করে,প্রতারনা করে, চুরি করে বা ছিনতাই সহ অন্য যে কোন উপায়ে টাকা সংগ্রহ করতেই হয়);

ও তা কোথায় নিরাপদে ব্যবহার করবে--

শুধু এই চিন্তায়ই সারাটি দিন কাটিয়ে দেয়

৬।গুরুত্ব পূর্ন সামাজিক, পেশাগত, বিনোদনমূলক কাজ বাদ দিয়ে থাকে( ৫নং এর জন্য)

৭।মাদকের কারনে তার শারিরীক,আর্থিক, সামাজিক,,পারিবারিক, মানসিক,নৈতিক- সর্ব ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষতি হচ্ছে তা জানা/বোঝা সত্বেও ঐ নেশা অব্যাহত রাখা

উপরোক্ত ৭টি লক্ষনের মধ্যে যদি ৩টি লক্ষনও কারো থাকে- তাহলে বুঝবেন সে ঐ মাদকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন বা এতে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন

# যে কোন বিষয়,বস্ত বা ড্রাগের ক্ষেত্রে এরকম নেশা তৈরি হতে পারে।তাই নেশাকে " বস্ত নির্ভরশীলতা( substance dependence)  বলা হয় শুধু মাদক নির্ভরশীলতা নয়।
## যাচাই করে দেখুন কোন বিষয়ে,বস্ততে কে কতটুকু আসক্ত হয়ে পড়েছে

( পর্ব- ২ তে কি কি দ্রব্যে নেশা/ নির্ভরশীলতা হয় এবং ব্রেইন মেকানিজম কি- এ নিয়ে আলোচনা থাকবে)

Sunday, May 13, 2018

সাইকোলজিক্যাল টিপস-৪২

১। বড় কিছু অর্জিত হলে,সফলতা পেলে, সুখী হবো -এমনটি না ভেবে
প্রতিদিনের  সাদামাটা জীবনের চারপাশে  যে ক্ষুদ ক্ষুদ্র আনন্দ, হাসি,সুখ,গর্ব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেগুলো ধারন করে সুখী হোন
     এবং
২।সে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখ,আনন্দ, সফলতা,অর্জন,গৌরব,সম্মানকে সানন্দে,সারম্ভরে উদযাপন করুন
   ( আমি করি -- আপনি করছেন তো?)

Friday, May 11, 2018

সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল --১৯:স্বেচ্ছা মৃত্যুর সুযোগ বাংলাদেশে ও চাই

অস্ট্রেলীয়ার ১০৪ বছর বয়সী বিজ্ঞানী ডেভিড গুডাল গতকাল সুইজারল্যান্ড এর লাইফ সার্কেল হাসপাতালে কষ্ট বিহীন ইনজেকশনে স্বেচ্ছা মৃত্যু বরন করেন।
আগেরদিন সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন

" আমার সামর্থ্য দিন দিন কমে আসছে...আমি সৌভাগ্যবান যে আমার শান্তি পূর্ন জীবনাবসান হচ্ছে আগামীকাল "।

এই সফল,সুখী, প্রকৃতি প্রেমিক বিজ্ঞানী স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরনের সিদ্ধান্ত কি আপনাদের অবাক করে?
এটা কি অনুমোদন যোগ্য?
একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে কি আমি এমনটি সমর্থন করতে পারি?

এরকম শত প্রশ্ন অনেকের মনে জাগতে পারে

।আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমরা সাইকিয়াট্রিস্টরা এবং আমি নিজেও প্রচুর লেখালিখি করছি।

তবে মানসিক রোগের কারনে বা অন্য যে কোন আবেগতাড়িত আত্মহত্যা কখনো সমর্থন যোগ্য নয়।

কেননা তাদের  যথাযথ চিকিৎসা দিলে বা তাদের মনোকষ্ট বা আবেগীয় সমস্যার সমাধান হলে তারা আত্মহত্যা করতো না,বরং জীবনকে আরো আনন্দময় ও সফল করতে সচেষ্ট হতো।

কিন্তু সেচ্ছা মৃত্যু আর আত্মহত্যা এক জিনিস নয়।

একজন মানসিক ভাবে সুস্হ ব্যক্তি ও বৃদ্ধ বয়সে সবদিক থেকে সফল ও সুখী মানুষ হয়ে ও স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

ফ্রয়েড এর পর সবচেয়ে বিখ্যাত  মনোবিজ্ঞানী এরিকসন তার "লাইফ সাইকেল" বা জীবন বৃত্ত তত্বে জীবনকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করেছেন

।একজন পরিপূর্ণ সফল ও সুখী মানুষ শেষ ধাপে জীবন সার্কেল সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত করেন এবং যাপিত জীবন নিয়ে পূর্ন তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি অর্জন করেন।
তখন তিনি জীবনকে পরিপূর্ণ ও সফল মনে করেন এবং আসন্ন মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকেন।

মৃত্যু তখন তার কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত, ভয়ের বা আফসোসের কোন বিষয় থাকে না।

এরকম জীবন সার্কেল সফলতার সঙ্গে পূর্ন করে সুখী,আত্ম তৃপ্ত মানুষের সংখ্যা কম হতে পারে, তবে কিছু তো রয়েছে।

আমি মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই যে আমি নিজকে সেরকম পরিপূর্ণ সফল ও সুখী একজন মানুষ মনে করি।

এখন এ বয়সে মৃত্যু বা জীবনাবসান আমার জন্য খুব স্বাভাবিক।
তাই বিজ্ঞানী ডেভিড গুডালের মতন পরবর্তী কোন অসামর্থ্য বা পীড়ন থেকে মুক্ত থাকতে সফল,সুখী  ও পরিপূর্ণ  জীবনকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে পোষন করলে তা ভুল বা আপত্তিজনক হওয়া উচিৎ হবে না।

মনে রাখতে হবে মানসিক ও শারীরিকভাবে কাবুল হয়ে,হতাশ হয়ে, বিষন্নতার জন্য আত্মহত্যার চিন্তা

আর সুস্হ অবস্হায়,তৃপ্ত পূর্ন জীবন নিয়ে শেষ বয়সে মৃত্যুকে বীরের মতন আলিঙ্গন করাকে এক করে দেখা যাবে না।

আমি এখন যে কোন সময় স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরনের জন্য প্রস্তুত।

স্বেচ্ছা মৃত্যুর মাত্র ২ দিন আগেও  সিএনএন কে সাক্ষাতকারে এই মহান বিজ্ঞানী বলেন

" আমি আবার যদি ঘন জঙ্গলের মধ্যে হাটতে পারতাম.....
আমি এখনো পাখির কিচিরমিচির  উপভোগ করি কিন্তু দৃষ্টি শক্তির সীমাবদ্ধতার জন্য সে সৌন্দর্য দেখতে পাই না"

কি অসম্ভব জীবনী শক্তি,প্রকৃতি প্রেম ও গভীর জীবন বোধ সম্পন্ন মানুষ তিনি।
তার পক্ষেই স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরন করার মতন সাহস দেখানো সম্ভব।

এ ক্ষুদ্র মানুষটিও এ দলে

কিন্তু আমাদের  দেশে সে মেডিকেলীয় ব্যবস্থা ও আইনি ব্যবস্থা অনুপস্থিত। বাংলাদেশে ও সেরকম সংস্কার চাই

Saturday, May 5, 2018

রোগ কাহিনী -২৯:মসজিদে গেলে সেখানে সামাজিক যুদ্ধ চলে কার ছেলে/মেয়ে কত ভালো করছে,কোথায় চান্স পেয়েছে-- যখন ক্লাশে ফার্স্ট হতে শুরু করলাম বাবাসহ সবাই বলতে লাগলো অন্য ছেলেরা কম পড়েছে তাই তুমি ফার্স্ট হয়েছো।

কাহিনী সংক্ষেপ :রোগীর মা বলেন স্যার দিনাজপুর থেকে এসেছি -

বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ নিউরোলজিস্ট দ্বীন মোহাম্মদ স্যার আমার সব কথা শুনে তাৎক্ষনিভাবে আপনার ঠিকানা  দিয়ে বলেন এখনি ওনার কাছে চলে যান।

মা,খালা ও রোগী আজমি যা বললেন :

বাবা একটি সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মা প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।

আজমির বাবা গ্রাম থেকে উঠে আসা ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। বোর্ডে স্টান্ড করা।দারিদ্র ও পারিপার্শ্বিক কারনে তিনি পরবর্তীতে তত ভালো করতে পারেননি।

তাই তিনি এখন তার অপূর্ণ স্বপ্ন একমাত্র ছেলেকে দিয়ে পূরন করতে চান। ছেলেকে সব সময় কন্ট্রোল করা ও আগলে রাখার চেষ্টা করেন

প্রতিদিন ভোরে উঠার জন্য ১ বার,দুপুরে খাবার ব্রেকে ১ বার ও বিকেলে হাটতে গেলে ১ বার ফোন করবেনই।

যদি ফোন রিসিভ না করে তাহলে ১৫-১৬ বার ফোন করতে থাকে( বলে তোমার কিছু হলে আমি বাচবো না)।

পড়ার সময় আত্মীয় স্বজন এলে বলে ওর কাছে যেওনা ওর পড়ার ডিস্টার্ব হবে,কিন্তু নিজে ছেলের পাশে বসে স্কুলের নানাবিধ সমস্যার কথা ছেলের কাছে শেয়ার করে।

বন্ধুদের বার বার ফোন করে জানতে চায় আজমি ক্লাশে আছে কিনা,কোথায় খাচ্ছে, কি খাচ্ছে।

এতে বন্ধুরা মজা পেয়ে তারা বলে আঙ্কেল ওতো ক্লাশ করে না,বাজে হোটেলে খায় ইত্যাদি।

এভাবে ওনার টেনশন আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়

।ছুটির দিনও হল থেকে বাসায় আসতে মানা করে কেননা এতে পড়াশোনার ক্ষতি হবে

।সারাক্ষণ খবরদারি করতো- টিভি দেখো কেন,এটা করা যাবে না,ওটা করা যাবে না-ইত্যাদি।

বানান ভুল করলে মারধর করতো।

বলতো ওমুকের ছেলের রোল ১ বা২ আর তুমি সবসময় ৮-৯ এ থাকো।

আজমি বলে ক্লাশ সিক্স এ উঠার পর আমার রেজাল্ট ভালো হতে থাকে।আমি ফার্স্ট হতে শুরু করি।

কিন্তু বাবাসহ অন্যরা বলে বাকী সবাই তেমন পড়াশুনা করে নাই, তাই তুমি ফার্স্ট হয়েছো

।সন্ধার পর কোন আড্ডায় যাওয়া নিষিদ্ধ। তুলনা করে বলে পাশের বাড়ীর মেয়েটি স্কলারশিপ পেয়েছে,ওমুকে তেমন করেছে।এরকম তুলনা করলে মন খারাপ হতো।

আজমি আরো বলে- স্যার মসজিদে নামাজ পড়ার পর এক সামাজিক যুদ্ধ বাধে- সবাই বড় গলায় বলতে থাকে কার ছেলে/ মেয়ে কত ভালো রেজাল্ট করেছে বা কত ভালো জায়গায় ভর্তি হতে পেরেছে।

এগুলো বাবার মনে জিদ তৈরি করে, আমার ছেলে পিছিয়ে থাকবে কেন?

আজমির সমস্যা শুরু ৫ বছর আগ থেকে যখন সে ক্লাশ টেনে পড়ে

।একসময় সে লক্ষ করে লিখতে গেলে তার আঙ্গুল শক্ত হয়ে যায়, লিখতে অসুবিধা হয়।তবে নিজেই মনের জোরে চেষ্টা করে ভালো হই

।আড়াই বছর পর আবার এ সমস্যা দেখা দেয় যখন এইচএসসি পরীক্ষার ২ মাস বাকী। একই সঙ্গে অতিরিক্ত স্বপ্ন দোষ হতে থাকে।ডাক্তার বলে এগুলো নরমাল।

আরো সমস্যা যোগ হয়- ঘাড় ভার হয়ে আসে,যেন কেউ একজন ঘাড়ে বসে আছে।

এই ভারে হাটতে গেলে মাথা নিচু হয়ে যেতো।পড়তে গেলে মাথা জ্বলে।

একদিন দেখি পুরো ঘরে ধোয়ায় ভরা,একটি লোকের লম্বা আঙ্গুল আমার গলা চেপে ধরতে আসছে।

আমি পা দিয়ে খাটে আঘাত করি যাতে শব্দ শুনে কেউ আসে।তারা আমার পা ও চোখ চেপে ধরে

।আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকি।কিছুক্ষণ পর সব পরিস্কার।

এর সঙ্গে আরেক সমস্যা শুরু হয়- কে যেন বলে আমি জানালার পাশে আছি,তোকে মেরে ফেলবো।

মনে হয় কে যেন পা ধরে টানে,মনে হয় বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছি।এসব কারনে পড়া শুনা বন্ধ হয়ে যায়।

খালাতো ভাই হুজুর আনে।তিনি অন্য একজনের উপর জ্বীন ঢেকে আনেন।

সে বলে তাবিজ আছে,জ্বীন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।এসব বলে হুজুর বলে ওকে আর ঝামেলা করবেন না।
এরপর হাত ঠিক হয়ে যায়।পরীক্ষার আর মাত্র ৩ দিন বাকি। তবু ও পড়া শুরু করি।

পরীক্ষার আগেরদিন কাউকে চিনি না,উদভ্রান্ত হয়ে পড়ি।

সকালে ৪ জনে ধরে নিয়ে হলে বসিয়ে দেয়( বাবা চান না ইয়ার লস হোক)। ম্যাডাম বলে যা পারো লেখো।

৫ বার উঠি,ম্যাডাম প্রতিবার বসিয়ে দেয়( যেহেতু বাবা বলে গেছে)। সে পরীক্ষায় ৮৬% এন্সার করে ৮২% মার্ক পেয়েছিলাম।

পরের দিন পরীক্ষা দেবো না।তখন নিউরোলজিস্ট দেখানো হয়।তিনি সিটি স্ক্যান করে বলেন কোন সমস্যা নাই।তবু পরীক্ষা দেই

।বন্ধুরা,বিশেষ করে মেয়েগুলো বলতে থাকে বেশী বেশী পড়তো বলে আজ এ অবস্হা।

প্রতিটি পরীক্ষা দেই আর হাতের সমস্যা তত বাড়তে থাকে।শেষদিন হাতের আঙ্গুল একেবারে বেকে যায়,কোন রকমে টেনে টেনে লিখা শেষ করি।

এরপর খালার বাসায় নিয়ে অন্য হুজুর দেখানো হয়।তিনিও একই কথা বলেন।এরপর হাতের সমস্যা কমে যায়।

খালা বলে স্যার ওর সমস্যা দেখা দিলেই হুজুরকে ফোন করে, আর হুজুর টাকা চায়। এভাবে অনেক টাকা দেওয়া হয়ে গেছে।

এরপর ভার্সিটির এডমিশন টেস্ট। সেখানেও কষ্ট করে পরীক্ষা দেই।তবু বি- ইউনিটে ৩৪ তম হয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ' ল সাবজেক্টে ভর্তি হই( জগন্নাথে ২১ তম হই)।

এরপর হাতের সমস্যার জন্য অর্থোপেডিক ডাক্তার দেখাই।একজন বলেন ট্রিগার আঙ্গুলে সমস্যা কিন্তু পিজিতে বলে কোন সমস্যা নেই

।কোনভাবে ফার্স্ট টার্ম দেই।সেকেন্ড টার্মের আগে আব্বুকে বলি দ্বীন মোহাম্মদ স্যারকে দেখাতে।ভালো হইনি।

তখন ম্যাডামের অনুমতি নিয়ে " রাইটার" নিয়ে ৬টি পরীক্ষা দিলাম।

এরপর অন্য সমস্যা দেখা দেয়-ঘুমাতে যাই কে যেন পা টেনে অন্য দিকে নেয়,আঙ্গুল শক্ত করে দেয়,হাত- পায়ের রগ দিয়ে বাতাস ঢুকে আমাকে অস্হির করে তুলে- মনে হয় সবাইকে মেরে ফেলবো,ভাংচুর করবো।

এবার দ্বীন মোহাম্মদ স্যারের কাছে গেলে সরাসরি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেয়।

এ কাহিনী থেকে যা শিক্ষনীয়:

১। লিখতে গেলে আঙ্গুল শক্ত হয়ে গিয়ে লিখতে না পারার রোগের নাম " writer's cramp"।

২। এটি একটি উদ্বেগ জনিত রোগ হলেও মূলত যারা পারফেক্টশনিস্ট( অতিরিক্ত নিখুত হতে চায় ) তাদের এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়।

৩। শিশু লালন পালন পদ্ধতি : মূলত ৪ ধরনের।তবে এখানে বাবাকে একাধারে অতি নিয়ন্ত্রণ ও অতি আগলে রাখার প্রবনতা দেখতে পাচ্ছি ( over control and over possessiveness)। এটি একটি মিশ্র পদ্ধতি।উভয় প্রবনতাই ক্ষতিকর।

৪। নিজেদের অপূর্ন স্বপ্ন সন্তানদের দ্বারা পূরন করার অবাস্তব চেষ্টা তাদের উপর বাড়তি চাপ তৈরি করে।

৫। সারাক্ষণ অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে আমরা সন্তানদের মনোবল ভেঙ্গে দেই,তাদের মনে হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দেই।

৬। সামাজিক যুদ্ধ - কার ছেলে/মেয়ে কত ভালো করেছে- এটি আমাদের সমাজে একটি ব্যাধি হয়ে দাড়িয়েছে।জিপিএ-৫ এর নেশায় অভিভাবকরা মরিয়া হয়ে সন্তানদের পিছে লাগছে

৭।  বাবার অতি নিখুত হওয়ার প্রবনতা আজমি পেয়েছে,অতি নিয়ন্ত্রণ, আগলে রাখার কারনে আত্মবিশ্বাস দুর্বল হয়েছে, অতি সামাজিক তুলনা ও সমালোচনায় হীনমন্যতা তৈরি হয়েছে,অতি প্রত্যাশা মনে আশঙ্কা তৈরি করেছে।

সব মিলিয়ে পরীক্ষা তার কাছে মূর্তিমান দৈত্য হিসেবে হাজির হয়- তার অবচেতন মন শঙ্কা ও উদ্বেগে ভারাক্রান্ত হয়।ফলে পরীক্ষার সামনে লিখতে  গেলে  তার " রাইটারস ক্রাম্প" শুরু হয়।

৮।  একই মানসিক দ্বন্দ্ব, সংঘাতের কারনে তার অবচেতন মনে অনেক চাপ পরে, যা তার ধারন ক্ষমতার বাইরে।

ফলে"dissociative- conversion"- রোগের লক্ষণ দেখা দেয়-

যার বেশীরভাগ লক্ষণকে আমাদের দেশে " জ্বীন-ভুতে" ধরার লক্ষণ মনে করা হয়।
৯। মনে রাখতে হবে শুধু মেধা থাকলে হবে না,মানসিক জোর,আত্মবিশ্বাস ও থাকতে হবে।তানাহলে মেধা কোন কাজে আসবে না।

১০। যেহেতু মানসিক রোগ - তাই হুজুর ও ধর্ম বিশ্বাস -রোগীর মনে এই বিশ্বাস ও আস্হা তৈরি করে যে এবার সে জ্বীনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে,তাই সাময়িকভাবে সে লক্ষণ মুক্ত হয়( আমরা একে বলি " placebo effect "।

১১।  কিন্তু রোগের মূল যে কারন তার অবচেতন মনের চাপ,দ্বন্দ্ব সেটির নিরসন না হওয়ার কারনে এবং মানসিক সক্ষমতা না বাড়ানোর কারনে, যখনি পরীক্ষা বা কোন চাপের মুখে পড়ে তখনি তার পূর্বের সমস্যা আবার দেখা দেয়।
১১। তাই জ্বীন- ভূত তাড়ানো নয়,তাদের দরকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা