Monday, June 4, 2018

সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার সিরিজ-৫: মাদকাসক্তিমাদক মুক্ত সমাজ গঠনে করনীয়

কাকতালীয় ভাবে হলেও " বিশ্ব তামাক বিরোধী " দিবস ও " বিশ্ব মাদক বিরোধী" দিবসের সমান্তরালে দেশব্যাপী চলছে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান।মাদকাসক্তি মানব জাতির একটি আদিম অভিশাপ। খ্রী:পূর্ব ৪ হাজার বছর পূর্বেই সুমেরিয়ানরা আফিম গাছকে " আনন্দ বৃক্ষ" নামে অভিহিত করতো।২ শত বছর পূর্বেই (১৮১০ সনে) বেনজামিন রাস বলেন, মদ পান শুধু অনৈতিক কাজ নয়,এটি একটি রোগ।বর্তমানে এটি প্রতিষ্ঠিত যে মাদকাসক্তি একটি "বায়ো-সাইকো-সোশাল" ডিসঅর্ডার বা মন- ব্রেইনের রোগ।আমি প্রথম আলোর মাদক বিরোধী কার্যকর্মের সঙ্গে যুক্ত এবং " মাদকাসক্তি :একটি ব্রেইনের রোগ" ও " মাদকাসক্তির চিকিৎসা সমগ্র " নামে দুইটি বই লিখেছি মাদকাসক্তির এ-টু- জেড সাধারন মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশ পৃথিবীর দুইটি বৃহৎ মাদক পাচার রুটের মধ্যে পড়েছে- গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ( লাওস,মায়ানমার, থাইল্যান্ড)  এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ( আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান)। এছাড়া ভারত,যেটি আফিম উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ সেটিও আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। একারনে বাংলাদেশ মাদক পাচারের কেন্দ্র ভূমিতে পরিনত হয়েছে
সমস্যার ব্যাপ্তি ও কুফল: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হার মতে পৃথিবীতে প্রায় ৫০ কোটি মাদকাসক্ত রয়েছে।জার্নাল অব হেলথ পপুলেশন এন্ড নিউট্রশন( জেএইচপিএন) অব আইসিডিডিআর,বি এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে  মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ। তবে অনেকের দাবী এটি ৭০ লক্ষ, এমনকি কোটির কোঠাও ছাড়িয়ে গেছে।তাদের তথ্য মতে: আসক্তদের ৭৯.৪% পুরুষ, ২০.৬%মহিলা;৮৫.৭% মাদক নেয় বন্ধুদের প্ররোচনায়; ৫৬.১% বেকার বা ছাত্র  এবং ৯৫.৪% ই ধূমপায়ী।
এনডিআইসি( ন্যাশনাল ড্রাগ ইনটেলিজেন্স সেন্টার) এর জরীপে বলা হয় আমেরিকায় মাদকের জন্য উৎপাদন ঘাটতি ১২০ বিলিয়ন ডলার;অপরাধ সংক্রান্ত ব্যয় ৬১ বিলিয়ন ডলার; ক্রিমিনাল জাস্টিস খাতে ব্যয় ৫৬ বিলিয়ন ডলার।সার্বিক ভাবে আমেরিকায় মাদকের জন্য ক্ষতি প্রতি বছর ৮২০ বিলিয়ন ডলার।এডিএম-২ (এরেস্টি ড্রাগ এবিউজ মনিটরিং প্রোগ্রাম)  এর  মতে গ্রেপ্তার কৃত অপরাধীদের ৬৩%-৮৫% মাদকসেবী। ব্রিটিশ পুলিশের তথ্যেও জানা যায় প্রায় ৫০% অপরাধী মাদকসেবী। বাংলাদেশের চিত্র ও এরকম হবে।কোন এলাকায় ৫% জন এইচআইভি পজিটিভ হলে মহামারি বলা হয়।অথচ  বাংলাদেশে ইনজেকশন নেয় এমন মাদকাসক্তদের মধ্যে এর হার ছিল কয়েকবছর আগে ১১%। এখন এ হার আরো বেড়েছে।একে বলে " কনসেনট্রেড ইপিডেমিক" যা দেশের জন্য এক অশনি সংকেত।
এ ছাড়া মাদকাসক্তির জন্য শারিরিক,মানসিক, সামাজিক, আর্থিক, নৈতিক, পারিবারিক  ক্ষয়ক্ষতি ও যন্ত্রণার দীর্ঘ লিস্ট তো রয়েছেই।কোন পরিবারে একজন মাদকাসক্ত থাকলে সে পরিবারে নরক নেমে আসে।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার : আমরা মাদকাসক্তির সমাধানকে ৩ ভাগে ভাগ করি-১। সাপ্লাই রিডাকশন২। ডিমান্ড রিডাকশন ৩। হার্ম রিডাকশন
সাপ্লাই রিডাকশন: মাদকের পাচার,সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মূলত স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্হার।প্রচলিত পন্হায় সফল না হয়ে সরকার এখন বিশেষ ক্রাশ প্রোগাম হাতে নিয়েছে।মাদক নির্মূলে যেকোন পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে  এরকম পদক্ষেপে মানবাধিকার বা আইনি নৈতিকতার বিষয়গুলো বাদ রেখেও বিশেষজ্ঞরা কিছু অভিমত তুলে ধরেন।বিশেষজ্ঞদের মতে সরবরাহ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আইন প্রয়োগকারী সংস্হা ও বিচার বিভাগ
এ রকম এক্সট্রিম মিজার নিলে জনমনে ঐ সব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা, সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।অথচ মাদক নির্মূলে  প্রয়োজন এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা,সক্ষমতা,বিশ্বাসযোগ্যতা আরো বাড়িয়ে তোলা।স্হায়ীভাবে ঐ অপরাধীদের দমন করে রাখা ও "ভয়ের" মধ্যে রাখতে হলে এর কোন বিকল্প নেই।
প্রতিরোধ : ক) পরিবারের ভূমিকা: সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা ও সৎ "যোগাযোগ "প্রতিষ্ঠা ;সঠিক নজরদারী ও তত্বাবধান; পারিবারিক " নিয়ম- রীতি" প্রতিষ্ঠা ;কার্যকর মনিটরিং ; পারিবারিক বন্ধন দৃড় করা; নৈতিক মূল্যবোধ শেখানো;অতিরিক্ত ও বল্গাহীন স্বাধীনতা না দেওয়া; দীর্ঘ ক্ষন সন্তানকে একাকী না রাখা
স্কুল; খুব ছোট থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।যা করনীয়: ক্রোধ, আক্রমণাত্বক আচরন নিয়ন্ত্রণ শেখানো; সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শেখানো; ভালোভাবে যোগাযোগ করতে সক্ষম করে তোলা; মাদকসহ যে কোন অবান্চিত আহ্বানকে " না" বলতে শেখানো; মাদক বিরোধী মনোভাব তৈরি ;সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা শেখানো
সামাজিক প্রতিরোধ ও সামাজিক আন্দোলন : মাদকাসক্তি একটি " সামাজিক ব্যাধি"। তাই এটির মূল উৎপাটন করতে হলে প্রবল সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন।বর্তমানে সমাজে যে সাড়া জেগেছে একে পুজিঁ করে  এ আন্দোলনকে আরো জোরালো করতে হবে ও সামনে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তরুন/ তরুনীদের করনীয়:  মাদককে " না" বলতে দ্বিধ্বা করবে না; তোমার হয়ে অন্যকে সিদ্ধান্ত নিতে দেবে না; মন্দ বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করে ভালো বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগ বাড়িয়ে দাও; মা- বাবাও মুরব্বিদের সঙ্গে  যোগাযোগ ও সংযোগ দৃড় করো; পারিবারিক " নিয়ম- রীতি" মেনে চলো; মাদক ছাড়াই জীবনকে উপভোগ করতে শেখো;সঙ্গীত, খেলা,শিল্প কলা,সমাজসেবায় নিয়োজিত থাকো; মাদক নিয়ে যে মিথ্যে ভুল ধারনা,মিথ রয়েছে সেগুলো জানো; নিজকে আদর্শ মডেল হিসেবে তুলে ধরো( থাইল্যান্ডে দেখেছি রাজকন্যার নেতৃত্বে তরুনদের জন্য " নম্বর ওয়ান" প্রোগ্রাম চলছে- যেখানে তারা মাদক মুক্ত থাকাকে নং ওয়ান বলছে); স্মার্ট হও,পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক নিজকে মাদকের ছোবল থেকে সুরক্ষিত রাখো; জীবনের দায়িত্ব নাও; মাদক ছাড়াই জীবনের চাপ,যন্ত্রনাকে ম্যানেজ করতে শেখো;আত্ম মর্যাদা বোধ সবল করো;
মাদকাসক্তির চিকিৎসা :  মাদকাসক্তি একটি ক্রনিক রিলাপসিং ডিসঅর্ডার ( ডায়াবেটিস এর মত)। তাই বহুমুখী, সমন্বিত ও দীর্ঘ স্হায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
মনস্বতাত্বিক চিকিৎসা :কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি; ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাউন্সিলিং; পুনঃআসক্তি প্রতিরোধ প্রোগ্রাম ; গ্রুপ থেরাপি / থেরাপিউটিক কমিউনিটি ; মটিভেশন এনহেন্সমেন্ট থেরাপি ; বিভিন্ন স্ব- সহায়তা গ্রপ( এলকোহলিক এনোনিমাস,নারকোটিক এনোনিমাস); ১২ - ধাপের কার্যক্রম- ইত্যাদি।
ঔষধ চিকিৎসা : ডিটক্সিফিকেশন ছাড়াও ঔষধ চিকিৎসা রয়েছে: হেরোইন জাতীয় মাদকের জন্য - মেথাডন,এলএএমএম,বুপরেনরপিন; মদ জাতীয় মাদকের জন্য - নেলট্রেক্সন,ডাইসালফিরাম,একামপ্রোসেট; ধূমপান প্রতিরোধে- নিকোটিন ডেলিভারি ডিভাইস, বুপরোপিয়ন।
পরিশেষে বলবো মাদকাসক্তি একটি " প্রতিরোধ যোগ্য " ব্যাধি। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাস্ট্র যদি সম্মিলিত প্রয়াস নেয় সমাজকে মাদক মুক্ত রাখা অবশ্য সম্ভব।তাই -- মাদকের বিরুদ্ধে --চলো যাই যুদ্ধে।
প্রফেসর (ডা.) মো. তাজুল ইসলাম
মনোরোগ ও মাদকাসক্তি বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কমিউনিটি এন্ড  সোশাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটউট ও হাসপাতাল
ই- মেইল:drtazul84@gmail.com

No comments:

Post a Comment