মাসুদ রানা,বয়স ১৩ বছর, ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।
৪ মাস আগে সে কোরান তেলোয়াত করছিল, তখন হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়।ঘন্টা খানেক অজ্ঞান থাকে। পরে আরো কয়েকবার এমন হয়
সে সময় তার শরীর কাপে,ঠোঁট কাপে এবং এরকম এক দেড় ঘন্টা থাকে।সে টের পায় কি হচ্ছে কিন্তু কথা বলতে পারে না।
তার বাবা তাকে রাজধানীর একটি বিখ্যাত প্রাইভেট হাসপাতালে, একজন নামকরা নিউরোলজিস্ট এর কাছে নিয়ে যান।তাকে এমআরআই সহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয় এবং তার ঐ খিচুনির ভিডিও রেকর্ড রাখতে বলেন।তাকে নিয়ে ঐ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নাকি বোর্ড মিটিং ও করা হয়।
খিচুনির ( ঐ শরীর কাপা,ঠোঁট কাপার) ঐ ভিডিও দেখে নিউরোলজিস্ট বলেন এটি মৃগী রোগ নয়- দেখে তো মনে হচ্ছে জ্বীন- ভূতের কিছু হবে।
আমি রোগীর বাবার কাছ থেকে এরকম কথা শুনে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।তাই নিশ্চিত হতে আবার জিজ্ঞেস করলাম, নিউরোলজিস্ট নিজে জ্বীন ভূতের কথা বলেছেন? তিনি মৃদু হেসে নিশ্চিত করলেন যে হা এমনটিই তিনি বললেন।
তারা নিজেরাও তেমনটি ভাবতেন।এরপর তারা হুজুরের কাছে নিয়ে যান।হুজুরের চিকিৎসায় সে আপাত ভালো হয়।জ্বীন ভূতের কথা শুনার পর থেকে ছেলেটি চোখের সামনে সাদা পাগড়ি পরা একজনকে দেখতো যে তার গলা চাপ দিয়ে ধরতে চায়।তখন সে চিৎকার করতে থাকে,কাদে,আম্মু আমাকে ধরো বলতে থাকে।
১৫-২০ দিন পড়ে সে টিভি দেখা অবস্থায় নিজেই মাকে ঢেকে বলে " মা আমি কিছু কানে শুনতে পারছি না- আমার কান বন্ধ হয়ে গেছে "।
মা দেখলেন সত্যি তাই।তবে কয়েক ঘন্টা পর হঠাৎ করে আবার কানে শুনতে শুরু করে।
এরপর কয়েকদিন পর পর সে ২-৩ ঘন্টার জন্য কানে শুনতো না,পরে আবার ঠিকই শুনতে পেতো।এবার ও নামকরা এক হাসপাতালে গিয়ে নাক, কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ দেখান।তিনি পরিক্ষা করে বলেন সব ঠিক আছে, সমস্যা নেই। কিছু ঔষধ দিয়ে দেন।
এর ২ সপ্তাহ পর স্কুলে যাবার পথ থেকে সে হারিয়ে যায়।
কে যেন তাকে উঠিয়ে কাঠালবাগান নিয়ে ফেলে যায়।সে বলে স্কুল যাওয়ার পথে হঠাৎ একটি দমকা বাতাস গায়ে লাগে। এরপর কি হয়েছে বলতে পারবে না।
জ্ঞান ফিরে সে দেখে কাঠাল বাগানে। সেখান থেকে পার্শ্ববর্তী এক দোকানদারের কাছ থেকে মোবাইল চেয়ে নিয়ে তার বাবাকে ফোন করে।পরে বাবা এসে তাকে নিয়ে যায়।
এরপর দুই এক দিন পর পর তাকে কে বা কারা নিয়ে যায় ( মিরপুর -১০; তালতলায়; হাবিবুল্লাহ রোড; বাসার কাছে; শেওড়াপাড়া - ইত্যাদি জায়গায়) । কোনবারই সে বলতে পারে না কিভাবে, কেমন করে সে ঐসব জায়গায় চলে যেতো।
তাকে যখন পাওয়া যেতো তার চেহারা কালো দেখাতো,ঘামে জামা কাপড় ময়লা থাকতো, ভীত,আতঙ্কিত দেখাতো।
এই যে ভয়ংকর জ্বীন দেখা, কানে না শোনা,প্রায়ই দূরে চলে যাওয়া / হারিয়ে যাওয়া- সবগুলো একই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে হতে থাকে।
সে যখন হারিয়ে যায়,তার পকেটে যে টাকা থাকতো তা অক্ষত থাকতো। সে টাকা দিয়ে নিজেই কয়েক বার বাসায় ফিরে আসে।
এ কাহিনী থেকে যা শিক্ষনীয়ঃ
১। ছেলেটি " ডিসোসিয়েটিভ- কনভার্সান " ডিসঅর্ডার এ ভুগছে।
কিছু সময়ের জন্য কানে কিছু না শোনা এবং মাঝে মাঝে শরীর কাপা,ঠোঁট কাপা- এ দুটি হচ্ছে " কনভার্সন"
( মনোসন্জাত কোন দ্বন্দ্ব, চাপের প্রতিক্রিয়ায় নিউরোলজিক্যাল কিছু সিম্পটম দেখা দেওয়া।নিউরোলজিক্যাল কোন কারন ছাড়াই শুধু মানসিক কারনে এরকম লক্ষণ গুলোর উদ্ভব হয়।)
হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া,যার কোন কিছু সে মনে করতে পারে না- এটি হচ্ছে " ফিউগ"(fugue) ডিসঅর্ডার( ছোট কালে শুনতাম পরিরা কাউকে তুলে নিয়ে গাছের মগডালে বসিয়ে দিতো।সে না জানতো গাছে চড়তে এবং কিভাবে উঠেছে তাও সে জানতো না)
+ সাদা পাগড়ি ওয়ালা কাউকে দেখা(যা অন্যরা দেখে না)-
এটি এক ধরনের " ভিজুয়্যাল হ্যালুশিনেসন।তবে এটি সাইকোসিস নয়।
উপরোক্ত দুটি " ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার "( মানসিক দ্বন্দ্ব, চাপের কারনে ব্রেইনের একটি অংশ মূল অংশ থেকে " বিচ্ছিন্ন "(ডিসোসিয়েশন) হয়ে যায় বলে, সে যা করে পরে তা তার স্মৃতিতে থাকে না)
২। এসব মানসিক রোগকে সাধারন মানুষ জ্বীন, ভূত,পরি ধরা মনে করতো এখনো করে।এ ভুল ভাঙ্গানোর দায়িত্ব আপনার, আমার সবার।
৩। তবে ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে ইদানিং এই তথাকথিত জ্বীন ভূতে ধরা রোগ বেশি দেখা দিচ্ছে।
এর প্রধান কারন যা আমি পর্যবেক্ষণে দেখতে পেয়েছি যে--
যে কোন মানসিক চাপ,ভয়ের কারনে তাদের মধ্যে প্রথমে " ডিসোসিয়েশন বা কনভার্সন " রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।
কিন্তু এরকম লক্ষণকে আত্মীয় স্বজনরা " জ্বীন ভূতের" ঘটনা মনে করে হুজুর দেখায়।সেখান থেকে শিশুর কোমল মনে( ব্রেইনে) এই লক্ষণ গুলোর সঙ্গে জ্বীন ভূতের একটি কানেকশন / সংযোগ তৈরি করে নেয়।
পরবর্তী সব ইপিসোডের সময় ঐ একই রোগ তখন জ্বীন- ভূতের আছড় নিয়ে হাজির হয়
৪। এর সঙ্গে যদি ডাক্তার / বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মুখ ফসকে জ্বীন ভূতের কথা বলে বসে, তাহলে তো আর কোন কথাই নেই।
৫। তাই এই ভূতুরে ( কাল্পনিক) " জ্বীন-ভূতের" রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে আপামর জন সাধারণ / চিকিৎসকদের মাথা থেকে ঐ " ভূত" প্রথমে সারাতে হবে।।
৬। সাধারণত একটি বা দুটি ধরন একই রোগীর হতে পারে।কিন্তু এ ছেলেকে ২ টি কনভার্সন,২ টি ডিশোসিয়েশন - মোট ৪ ধরনের রোগ পেয়ে বসেছে। এমনটি হওয়ার কারন রোগীর মূল মানসিক দ্বন্দ্ব, ভয়,চাপকে নিরসন না করে অপচিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া।
তাই এ ধরনের রোগীকে অপচিকিৎসা না করে দ্রুত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এর অধীনে চিকিৎসা করাতে হবে
No comments:
Post a Comment