প্রতি বছর,১০ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী "বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস " পালিত হয়।এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে "আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন "। মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা দুটোই জাতীয় ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন হলে আত্মহত্যা সহ অন্যান্য হত্যা, সহিংসতা, অপরাধ
বহুলাংশে কমে আসবে। আশার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু দেশেই নয়,এবার জাতিসংঘে গিয়ে ও মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের জন্য, পৃথিবীর অন্যান্য রাস্ট্রকেও আহ্বান জানিয়েছেন।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ২০১৩ সনেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৪টি সদস্য রাস্ট্রের সম্মতিতে, একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেন, যাতে বলা হয় সদস্য রাস্ট্র গুলো ২০২০ সনের মধ্যে, আত্মহত্যার হার ১০% কমিয়ে আনবেন ও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ২০% বাড়াবেন(হু,সাক্সেনা, ২০১৩)।এসডিজি ২০৩০ এর লক্ষ্য মাত্রা ও একইরকমের।এখন দেখার বিষয় সে অনুযায়ী আমরা কতটুকু লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি।
সংখ্যা তথ্য ঃপ্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৮ লক্ষ লোক আত্মহত্যা করে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন। ১৫-২৯ বছরের তরুণ তরুণীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারন আত্মহত্যা, ৭৯% আত্মহত্যা ঘটে আমাদের মতন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ গুলোতে।বিশ্ব জুড়ে সহিংসতার, পুরুষের ক্ষেত্রে ৫০% আত্মহত্যা জনিত ও নারীর ক্ষেত্রে ৭১% আত্মহত্যা জনিত (হু-২০১৪)।
অনেকে মনে করেন স্বার্থপর লোকেরা আত্মহত্যা করে, তাদের প্রতি সহানুভূতি জানানো ঠিক না।কিন্তু আসলেই কি আত্মহত্যা এতো সহজ ব্যাপার? মনোবিজ্ঞানী জয়েনার বলেন -"হত্যা করা কঠিন, বিশেষ করে নিজেকে হত্যা করা।কেননা শারীরবৃত্তীয় ভাবে আমরা "বেচে থাকার" জন্য তৈরি হয়েছি।"আমরা জীবনের সব সম্পদ ত্যাগ করে হলেও বেচে থাকতে চাই।
সেন্টার ফর সুইসাইড প্রিভেনশন এর লেখক রবার্ট ওলসন , আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেচে যাওয়া একজনের নোট তুলে ধরেন-"আমি শুনেছি লোকে বলে যারা আত্মহত্যা করে তারা স্বার্থপর। কিন্তু এটা সত্যি নয়।যে মুহূর্ত পর্যন্ত আপনি সেই চরম, নিঃসীম অন্ধকারকে অনুভব না করবেন;আশাহীনতা, কষ্ট আপনাকে বলবে পৃথিবীতে তোমার কিছু করার নেই; সেই বিরামহীন বেদনা বন্ধের একমাত্র পথ হচ্ছে এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে নিজেকে "সরিয়ে নেওয়া ",ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি তাদের মনের মর্ম যন্ত্রনা বুঝতে পারবেন না। "
এইরকম চরম মুহূর্তে তারা কিরকম ভাবে, এটি তার একটি ভূতাপেক্ষ আভাষ মাত্র। একই রকম চিত্র পাই নাতাশা ম্যুলারের পর্যবেক্ষণ থেকে। তিনি লিখেছেন -"আমার বাবা সহ আরো তিনজনের আত্মহত্যা আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। বিষন্নতা ও উদ্বেগের "দানব" যখন কাউকে পেয়ে বসে,তাদের জীবনে তখন কোন "ঐন্দ্রজালিক, মোহনীয়" মুহূর্ত থাকে না-যখন পরিস্থিতির "একটু খানি হলেও উন্নতি " হয়েছে বলে তারা মনে করতে পারে বা হঠাৎ কোন "শান্তি " তাদের উপর বর্ষিত হয় না। কিছু একটা স্হায়ী ভাবে বসে থাকে যার বন্ধন থেকে তারা মুক্ত হতে পারে না। "।
তিনি আশার কথা ও লিখেন-" যে আমি আত্মহত্যার ভারবহ আঘাত বয়ে বেড়াচ্ছি, আমি তাদেরকে বলছি, যারা বিষন্নতার সহিত যুদ্ধ করছেন, তাদের বলছি, যাদের আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসছে -বিষন্নতার যে অদৃশ্য কালো হাত আপনার মাথা চেপে নুইয়ে রেখেছে, সে চাপ একসময় সরে যাবে। জেনে রাখুন এখনো আশা,প্রত্যাশা রয়েছে। আমি বেচে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং এ যুদ্ধ অব্যাহত রাখার প্রতিজ্ঞা করেছি "।
মনে রাখতে হবে ৯০% আত্মহত্যাকারীদের কোন না কোন মানসিক অসুস্থতা থাকে।(হয়েটন,২০০১)। এর মধ্যে রয়েছে -ডিপ্রেশন, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ম্যুড ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের ক্রুটি, উদ্বেগ জনিত রোগ ইত্যাদি। ৪০টির ও অধিক গবেষণায় দেখা গেছে ৭৫% আত্মহত্যাকারী বিগত ১ বছরের মধ্যে অন্তত একবার তাদের জেনারেল প্রাকটিশনার ডাক্তারের সঙ্গে মানসিক অস্হিরতা ও আবেগীয় সমস্যা নিয়ে দেখা করেন।কিন্তু প্রশিক্ষণের ঘাটতি, সময়ের অভাবে বা দৃষ্টিভঙ্গির কারনে মানসিক বা আবেগীয় সমস্যা চিন্হিত করা হয়নি।(ল্যুমা,২০০২)।এমনকি হাসপাতালে ভর্তির ৭ দিনের মধ্যে ও হাসপাতাল ত্যাগের তিন মাসের মধ্যে অনেক মানসিক রোগী আত্মহত্যা করে থাকে(মিহ্যান,২০০৬)।
শুধু তাই নয়,বন্ধু -বান্ধব, নিকটাত্মীয়, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ও তারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নিজেদের অসহায়ত্ব, যন্ত্রণার কথা নানাভাবে প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু আমরা সেই নীরব আর্তনাদ শুনতে বা দেখতে পাই না বা সেটিকে তেমন গুরুত্ব দেইনা।তারা কয়েক দিন বা কয়েক ঘন্টা আগেও তাদের আকুতি, বেদনার কথা জানান দেওয়ার চেষ্টা করে। যেমন " আমি আর পারছি না ";কোন কিছুতেই আর কিছু হবে না ";" মরন কেন আসে না"-ইত্যাদি।
জয়েনার তার ইন্টার-পারসোনাল থিওরি অব সুইসাডিলিটি তত্ত্বে বলেন -"মানুষ তখনই আত্মহত্যার চেষ্টা করে যখন তারা "ধারনাগত দুঃসহ, দুর্বহ" কষ্টে ভুগে ;ভাবে তারা আর কারো জন্য প্রয়োজনীয় নয়;এবং অন্যদের সঙ্গে তাদের একাত্মতা বোধ কমে যায় "। তিনি আরো বলেন -"এর সঙ্গে নিজেকে আঘাত, আহত করার যে ভয় বা কষ্ট সেটিও তাদের কম থাকে "। এই কারণে কিছু সংখ্যক কিশোরী, নারীর বারবার নিজেকে আহত,আঘাত করার ইতিহাস থাকে। তারা আবেগীয় কোন সমস্যায় পড়লেই " ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে আহত/আঘাত "করে থাকে (ডেলিভারেট সেলফ্ হার্ম)। যেমন -ব্লেড দিয়ে হাত কাটা,ঘুমের ঔষধ খাওয়া ইত্যাদি। এদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি থাকে ;হতাশা সহ্য করার ক্ষমতা কম থাকে ;তাৎক্ষণিক ইচ্ছা, বাসনা চরিতার্থ করার তাগিদ বেশি থাকে ;আবেগতাড়িতভাবে, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে কাজ করার (ইম্পালসিভ) প্রবনতা থাকে। এদের মানসিক কাঠামো সবলও নমনীয় করার জন্য পূর্ব থেকেই মনোচিকিৎসা নিলে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
গত বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যা প্রতিরোধে ৪টি গাইডলাইন দেন।সেগুলো হচ্ছে -১। আত্মহত্যার পদ্ধতি /মাধ্যমের সহজলভ্যতা কমিয়ে আনা। যেমন আমাদের দেশে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা বেশি হয়ে থাকে। তাই কীটনাশক কেনা,বিক্রি মনিটরিং করা;কেনার পর কৃষক বিষের বোতল একটি নির্দিষ্ট কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখবে;বিষের প্রাননাশক তীব্রতা কমিয়ে আনা;ঘুমের ঔষধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনার উপর নজরদারি করা -ইত্যাদি। ২। সংবাদ মাধ্যম কর্মীদের আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশে কিছু গাইড লাইন মেনে চলা ৩।তরুণ তরুণীদের " সমস্যা সমাধান "দক্ষতা, " খাপ-খাইয়ে নেওয়ার "দক্ষতা ও " জীবন "দক্ষতা বৃদ্ধি করা৪। আত্মহত্যার ঝুকিতে যারা তাদেরকে পূর্ব থেকেই চিন্হিত করা।
এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রস্তাব করেন।এর নাম-বিআইসি(ব্রিফ ইন্টারভেনশ এন্ড কন্টাক্ট) । রিবলেট ৭২টি গবেষণা পর্যালোচনা করে বলেন এই চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকর।
যত্নশীল সংলাপ /কথোপকথন ঃআত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের মতন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, প্রতিষ্ঠান বা সরকার ছাড়া ও আপনি নিজে ও অনেক কিছু করতে পারেন। ঝুঁকি পূর্নদের বেচে থাকার যথেষ্ট যুক্তি, কারণ রয়েছে সেটি খুঁজে নিতে সাহায্য করতে পারেন ;তাদেরকে অবস্থার ভিন্ন ও ইতিবাচক প্রেক্ষিত দেখিয়ে নতুন অন্যদৃষ্টি তৈরি করতে পারেন; এবং তাদের কথা আগ্রহ সহকারে ও সক্রিয় মনোযোগ দিয়ে শুনুন। সেইডন সানফ্রান্সিসকোর বিখ্যাত গোল্ডেন গেইট ব্রিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেচে যাওয়া লোকদের উপর করা জরীপে দেখেছেন, বেচে যাওয়াদের ৯০% পথচারী, ব্রিজ পাহারাদার ও পুলিশ দ্বারা রক্ষা পেয়েছেন। দেখা গেছে এরপর পরবর্তীতে তারা আত্মহত্যার আর কোন চেষ্টা করেননি। তার মানে, কোন ভাবে তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারলে, তারা সারা জীবন ভালো থাকবেন।
তবে এও মনে রাখতে হবে কিছু সংখ্যক রোগী রয়েছে যারা বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ও করবে। এরা খুবই ঝুঁকি পূর্ন এবং তাদেরকে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসার আওতায় রাখতে হবে।
ডিপ্রেশন সব কিছু ধুমড়ে,মুছড়ে, পিষে একাকার করে ফেলে। তাই সে সময় জীবন দৃষ্টি খুবই সীমিত ও একপেশে হয়ে থাকে এবং নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও একাকী মনে করে। কিন্তু আমাদের "প্রসারিত ও বিস্তৃত " হতে হবে। অশান্তি, কষ্ট, হতাশা, ব্যর্থতা ঢেউয়ের মতন জীবনে আসবে আবার চলেও যাবে। যখন সে ঢেউ উত্তুঙ্গ হয়,আমাদেরকে সে চূড়ায় সওয়ার হয়ে ভেসে থাকার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আমরা যখন নীচ থেকে নিজেকে চূড়ায় উঠিয়ে আনতে পারি, তার মানে আমরা অধিকতর শক্তিশালী এবং আমরা আরো বেশি শক্তিশালী হবো, যখন আমরা এই চড়াই -উতরাইয়ে একত্রে সংগ্রাম করবো, লড়বো।
অধ্যাপক ডা. মোঃ তাজুল ইসলাম
প্রফেসর অব সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ও হাসপাতাল, ঢাকা
ইমেইল ঃdrtazul84@gmail.com
Phone -01715112900
Thursday, October 3, 2019
আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment