মোটাদাগে জরীপেে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে মা -বাবার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে কিনা,পারিবারিক বন্ধন কমে গেছে কিনা,তরুণরা কাদের সঙ্গে নিজেদের সুখ-দুঃখ বা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে ইত্যাদি। একই সঙ্গে এসবের কারণ কি, এমনকি সমাধান কি তাও জরীপেে তুলে ধরা হয়েছে।
পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে ঃঃ জরীপেে দেখা যায় মা-বাবার সঙ্গে তরুণদের দূরত্ব বাড়ছে, যার হার ৭৮.১%।পারিবারিক বন্ধন কমেছে ৭৮.২% বলে তরুণরা মনে করে।এই দূর্রত্ব বৃদ্ধি ও বন্ধন শিথিল হওয়ার কারনে তাদের মধ্যে হতাশা, মাদকাসক্তি, অবসন্নতা, নৈতিক স্খলন প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জরীপেে উল্লেখ করা হয় । এরকম ফলাফলকে যথার্থ বলে মনে হয়। কেননা জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ, বলিষ্ঠ আত্মপরিচিতি গঠন, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান গড়ে ওঠার মূল পাঠাতন হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন ও মা-বাবার সঠিক সন্তান লালনপালনের কল্যাণকর প্রভাব। মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি পেলে বা পারিবারিক বন্ধন দূর্বল হলে সন্তানদের এরকম বিচ্যুতি স্বাভাবিক।
জরীপেে উল্লেখ করা হয়েছে দূরত্ব বৃদ্ধির কারণ মা-বাবার কর্মস্থলে ব্যস্ততা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়া। কর্মস্হলে থাকার কারনে যে সময় কম দেওয়া সেটির ঘাটতি মা-বাবা পূরণ করতে পারে "গুণগতমানের "সময় দিয়ে।আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি থাকলে সন্তানরা এর অনুসরণ করবে এবং সন্তান যথাযথ মনোযোগ ও যত্ন থেকে বঞ্চিত হবে। তাই তাদের এই নিজেদের আসক্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে এবং সম্তানদেরকে ও এসব বিষয়েে " আত্মনিয়ন্ত্রণ" করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
এই জরীপেে আরো দেখা যায় ৫৩% তরুন-তরুণী অবসর সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও ইন্টারনেটেে সময় ব্যয় করে থাকে এবং শিক্ষিত তরুনদের মধ্যে এ হার অনেক বেশি-৭০%। আমাদের অভিজ্ঞতা এ হার আরো বেশি হতে পারে। তবে কত ঘন্টা সময় ব্যয় করে সে তথ্যটুকু আরো জরুরি ছিল। তরুণরা এ জন্য খেলাধুলা ও শিক্ষাকার্যক্রমেে যুক্ত থাকার সুযোগের অভাবকে দায়ী করেন। তবে বন্ধু বান্ধবদের প্ররোচনা,সুস্থ বিনোদনের অভাব,মা-বা, শিক্ষকদের তদারকি ও নজরদারির অভাব সহ আরো অনেক উপাদান ও দায়ী।
কিছু সংখ্যক তরুণ এর কিছু সুফলের কথাও উল্লেখ করেন। তাদের মতে এসব সামাজিক মাধম লেখাপড়ার কাজে, উৎপাদন ও উপার্জনের কাজে, চাকরি-বাকরী, পরীক্ষার প্রস্তুতি, এসাইনমেন্ট তৈরি, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন সহ প্রভূত কাজে লাগে। এর সঙ্গে আমরাও একমত। আধুনিক প্রযুক্তির কিছু কুফল থাকলে ও এর উপকারিতা অসীম। শুধু প্রয়োজন ঐসব কুফল এড়িয়ে কিভাবে এর সঠিক ও গঠনমূলক ব্যবহার বাড়ানো যায় সেরকম প্রয়োগ কৌশল তাদের শিখিয়ে দেওয়া।
মা -সর্বকালের ভরসা -কিন্তু বেচারা বাবা ঃঃ জরীপেে দেখাযায় ৫১.৪% তরুনের মূল ভরসা মা। গ্রামেে এ হার কিছুটা বেশি। অথচ বাবাদের প্রতি ভরসা মেয়েদের ১৮.৩% ও ছেলেদের ৩২.৮%। জন্ম থেকেই মায়ের সঙ্গে সব সন্তানের একটি "আত্মিক বন্ধন " (এটাচমেন্ট) তৈরি হয়। শৈশবের পুরো সময় সকল প্রকার প্রয়োজন, চাহিদা, নিরাপত্যতা যত্নের মূল দায়িত্ব পালন করে মা। এমনকি কৈশোর-তারুন্যে ও এই নির্ভরশীলতা অটুট থাকে। বাবারাা হয় খেলার সাথী। বাবারা নিজেরাও এমনকি বৃদ্ধবয়সে ও তাদের মায়েদের উপর ভরসা রাখে। প্রকৃতির এ এক অমোঘ নিয়ম।তবে লক্ষনীয়, মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বাবার কাছে বেশি ভরসা রাখে, যদি ও বন্ধুর তুলনায় খুবই কম। এর কারন লিঙ্গ, সমাজ, কর্মপরিধি ও বাস্তব প্রয়োজন। কিন্তু আশঙ্কার কথা ছেলেদের এই ভরসা যতদিন যায় তত কমতে থাকে। জরীপেে দেখা যায় বাবারপ্রতি এই ভরসা ১৫-১৯ বছরেে যেখানে ৩৩.৪% সেটি ২৫-৩০ বছরেে দাড়ায় কমে ১৮. ৭%।হায় বেচারা বাবা।
হতভাগ্য স্ত্রী -ভাগ্যবান বন্ধু ঃঃ জরীপেে দেখা যায় ছেলেরা সমস্যার কথা, সুখ-দুঃখের কথা বেশি শেয়ার করে বন্ধুদের সাথে -৫৮.১%,এর পর মা-৫২.১% এরপর বাবা -৩২.১৩% এবং সর্বশেষেে হতভাগ্য স্ত্রী /সঙ্গিনী -মাত্র ৬.৯% । এমনকি ভাইবোনের চেয়ে ও কম আলোচনা করে সঙ্গিনীর সাথে ।
পুরুষদের এই অতিরিক্ত বহিঃমুখিতা, সংসার বৈরাগী মনোভাব , পরিবার ও সমাজেে অনেক বিড়ম্বনা, কষ্ট, জটিলতার জন্য দায়ী। দাম্পত্য জীবনেে বহুবিধ আবেগগত, মানসিক সমস্যা নিয়ে অনেক নারী আমাদের কাছে এসে থাকে। এর বেশিরভাগ কারণ স্বামীর কাছ থেকে অবজ্ঞা, অবহেলা, নির্যাতন। স্ত্রী /সঙ্গিনীর প্রতি অমনোযোগ, অনাগ্রহ, অযত্ন, যোগাযোগহীনতা দাম্পত্যকলহ ও অশান্তির অন্যতম কারণ।
অথচ জরীপে দেখা যায় ৪৪.৫% নারী সঙ্গি /স্বামীর সঙ্গেই সুখ দুঃখের কথা বলে থাকে। মূলত মায়ের পর মেয়েরা সঙ্গীর সঙ্গে বেশি শেয়ার করে ।
এদিকটি তাই খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। পুরুষ স্বভাবের এই মন্দ দিকটি নিয়ে সকল পুরুষকে গভীরভাবে পুনবিবেচনা করে দেখতে হবে।
এ প্রজন্মের বড় সমস্যা -মানিয়ে নিতে না পার ঃঃ
পরিবার, সমাজ, জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তরুনদের উদ্বেগ উল্লেখযোগ্য। এই মানিয়ে নিতে না পারার হার মেয়েদের মধ্যে বেশি-৭৫%। জরীপেে উল্লেখ করা হয় তাদের এই উদ্বেগ এতো বেশি যে তা জীবনের লক্ষ্য, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, চাকরি বাকরী বা পড়াশোনা কোনটাই নাকি এর মতন সমান উদ্বেগেেের বিষয় নয়। মূলত কৈশোর-তারুন্য সময়টি জীবনেেের একটি সন্ধিক্ষন। এসময়ে শারীরিক বৃদ্ধি দূরুত বৃদ্ধি পায়। কিন্তুএর সাথে তাল মিলিয়ে মানসিক, সামাজিক, বৌদ্ধিক, নৈতিক বিকাশ তেমন এগুতে পারে না। একদিকে মনে হয় তারা বড় হয়ে গেছে, তারা নিজেরাও তেমনটা ভাবে। অথচ বাস্তবেে তাদের মনন সেরকম পরিপক্ব নয়। এজন্য তাদেরকে জীবন, সমাজ এমনকি নিজের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করে যেতে হয়। সে যুদ্ধখুবই অসম। তাই তাদের মনে হয় আমি বে-মানান, আমি কিছুর সঙ্গেই মানিয়ে নিতে পারছি না। অভিভাবক, শিক্ষকগনের এ সময়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। তানাহলে তারা দিশেহারা, লক্ষ্যবিহীন হয়ে যেতে পারে। এসময় তাদের প্রয়োজন সহমর্মি, সহযোগিতা, সমর্থন ও ভালোবাসা-উপদেশ বা কঠোর শাসন নয়।
সামাজিক বন্ধন ও শিথিল হচ্ছে ঃ ৮৫% তরন বলছে তাদের সামাজিক বন্ধন ও কমে যাচ্ছে। এটামোটেই অপ্রত্যাশিতনয়,কেননা পারিবারিক বন্ধন কমে গেলে সামাজিক বন্ধন অটুট রাখবে কিভাবে? তরন প্রজন্মের বিপথে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ এই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হওয়া।
ভয়ঙ্কর সংবাদ- কারো প্রতি আস্হা নেই ঃঃ এতোক্ষণঅনেক নেতিবাচক তথ্যের উল্লেখ করলাম কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে ৬.৭% তরন কারো উপরই ভরসা করতে পারছে না। এ হার শহরে আরো বেশি -৯%। যে মানুষ কারো উপর আ, ভরসা রাখতে পারে না, মা-বা, ভাই বোন,বন্ধু, সমাজ কারো উপর যারা ভরসা নেই তারা নিজেদের জন্য যেমন তেমনি সমাজের জন্য ও হতে উঠতে পারে ভয়ংকর। পুরো আশাহীন, অসহায় মানুষ হয় নিজকে শেষ করে দিতে চাইবে, নতুবা চারপাশের সবকিছু চুরমার করে, লডভন্ভ করে , হতাশা, অসহায়ত্বের ভার লাঘব করতে চাইবে।
এখন সমাজ, রাস্ট্র কি এদের কোন ভরসা দিতে এগিয়ে আসবে? জরীপের এইরকম ফলাফলকে পাল্টে দিতে, অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হলে রাস্ট, সমাজ, পরিবার, তথ্যমাধ্যম, বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে ইতিবাচক, শুভ উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে নিতে হবে। আমরা সবাই একটি মানবিক, মননশীল, সৃজনশীল, আশাবাদি, কর্মমুখী, জীবনমুখী ও প্রানোচ্ছল প্রজন্ম দেখতে চাই।
প্রফেসর ডা.মো . তাজুল ইসলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
ইমেইলঃঃ drtazul84@gmail
No comments:
Post a Comment