Tuesday, August 29, 2017

সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল-১৩:প্রসঙ্গ " পরিপক্কতা বনাম অপরিপক্বতা "

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে জাতীয় সংসদ এখনো " অপরিপক্ব " বলাতে দেশব্যাপী তুমুল হৈচৈ শুরু হয়েছে।সংসদ তো অনেক উপরের ব্যাপার আমরা আদার ব্যাপারি তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।কিন্তু আমরা আমজনতা কে কতটুকু "পরিপক্ব " তার একটি যাচাই- বাছাই  হয়ে যেতে পারে:

আসুন যাচাই করি আমি,আপনি কতটুকু পরিপক্ব :

১। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন আপনি অন্যকে " বদলানোর" চেষ্টা বন্ধ করবেন, বরং নিজকে বদলানোর দিকে মনোযোগী হবেন।

২। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন মানুষ যেমন সেভাবেই তাকে আপনি মেনে নিবেন/ গ্রহন করবেন

৩। পরিপক্বতা হচ্ছে প্রত্যেকে যারযার অবস্হান থেকে সঠিক এটি বুঝতে পারা

৪। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন " চলে যেতে/ ছেড়ে দিতে" ( লেট গো) শিখবেন

৫। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন " সম্পর্কের" ক্ষেত্রে " প্রত্যাশা গুলো" বাদ দিতে পারবেন এবং বিনিময় ছাড়া " দেওয়ায়" বিশ্বাস করবেন।

৬। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন আপনি বুঝবেন আপনি যা করেন আপনার শান্তির জন্য  করেন

৭। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন আপনি পৃথিবীর কাছে আপনি কতটুকু বুদ্ধিমান এটি প্রমান করার চেষ্টা বন্ধ করেন

৮। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন আপনি অন্যদের কাছ থেকে সমর্থন, পছন্দ, অনুমোদন চেয়ে বেড়াবেন না

৯। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন আপনি নিজের মধ্যে সুখে- শান্তিতে থাকেন

১০। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন আপনি " প্রয়োজন( নিড)" ও " চাহিদা( ওয়ান্ট)" এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন এবং চাহিদাগুলোকে বাদ দিতে পারবেন

১১। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন আপনি অন্যের সঙ্গে নিজকে " তুলনা" করা বন্ধ করতে পারবেন

১২। পরিপক্বতা হচ্ছে যখন আপনি পার্থিব,বৈষয়িক সম্পদের সঙ্গে " সুখকে" সংযুক্ত করা বন্ধ করতে পারবেন

( এখন নিজেই যাচাই করুন আপনি কতটুকু " পরিপক্ব "।মাননীয় সাংসদদের এই পরীক্ষা থেকে বাদ রাখতে হবে)

Thursday, August 24, 2017

রোগকাহিনী-২০:বনের বাঘে খায় না,মনের বাঘে খায়-রোগ সামান্য - পরিনাম অসামান্য

স্যার কয়েক বছর যাবৎ "ঘর- বন্ধি", এমনকি  পাশে বাথরুমে ও একা যেতে পারতাম না

কাহিনী সংক্ষেপ : মিসেস সাহারিনা,,বয়স-৩২। বাচ্চাকে স্কুলে দিতে গেলে অন্য ভাবীরা প্রেসার,হার্ট এটাক,কিডনি রোগ ইত্যাদি নিয়ে গল্প করতো।এগুলো শুনতে শুনতে আমার মাথা গরম হয়ে যেতো।একদিন অজ্ঞান হয়ে যাই।ক্লিনিকে নিয়ে গেলে ডা. বলে সামান্য হাই ব্লাড প্রেসার আছে( আতঙ্ক, ভয়ের সময় প্রেসার এমনিতেই কিছুটা বেড়ে যায়)। ২-৩ মাস পর আমার ডেলিভারির সময় আমার পালপিটেশন বেড়ে যায়,সঙ্গে প্রেসারও।ডা. বলে আপনি আতঙ্কিত তাই এমনটি হচ্ছে( সঠিক সাজেশন ছিল)। কিন্তু ডেলিভারি হওয়ার পর আতঙ্ক আরো বাড়ে।প্রায়ই প্রেসার আপ- ডাউন করে।আমি ভয়ে ঘন ঘন প্রেসার মাপাতাম।প্রেসারের ঔষধ খাওয়ার পর অবস্হা আরো খারাপ হয়।কোন  মৃত্যু সংবাদ শুনতে পারতাম না,দুঃসংবাদ শুনতে পারতাম না।এক সময় এমন হয় টিভি দেখা বন্ধ করে দেই যেহেতু কখন সংবাদে কোন দুর্ঘটনার সংবাদ প্রচারিত হয় এই ভয়ে।
অস্হির লাগতো,সব সময় ভয় এই বোধ হয় মারা যাচ্ছি। ঘর থেকে বের হতে পারতাম না প্রেসার বেড়ে যাবে,মারা যাবো। বাসায় স্বামী পাশে তাও ভয়।মন একেবারে দুর্বল হয়ে গেলো।বাথরুমে ও একা যেতে পারতাম না।দরজা লাগাতাম না যদি এটাকের সময়  দরজা খুলতে না পারি।একই ঘরে ও পাশের রুমে একা যেতে পারতাম না।অন্ধকার হলে রুম থেকে বের হতে পারতাম না।বাচ্চা কিছু কিনে দেওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতো কিন্তু ভয়ে নীচে নামতাম না দোকানে যেতে।স্বামী চাকরি করে তাই বাচ্চা স্কুলে নিতে হতো আমাকে।ভয়ের কারনে বাচ্চা স্কুলে নিতাম না।এভাবে তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।গত কয়েক বছর বাবার বাড়ী,শ্বশুর বাড়ী কোথাও যাইনি- এই ভয়ে( ঘর থেকেই বের হতে পারি না,দূরে কেমনে যাবো?) ।
ডাক্তার দেখাতে ও যেতে চাইতাম না,যদি পরীক্ষা নিরীক্ষায় কোন খারাপ রিপোর্ট আসে? জোর করে নিয়ে গেলে ডা. রুমে ঢুকে আরো অসুস্থ হয়ে পড়তাম।স্বামী, বাচ্চাদের চেপে ধরে  বসে থাকতাম। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছি, তারা বলে পরীক্ষায় কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি,কিন্তু রেফার করে না
।আমি হাসি ভুলে গিয়েছিলাম। এখন যে এতো কথা আপনাকে বললাম,তখন ডাক্তারদের কাছে কিছুই বলতে পারতাম না।
চিকিৎসার পর তিনি নাটকীয় ভাবে উন্নতিলাভ করেন

যতবার তারা ভিজিটে আসে প্রতিবারই কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে স্বামী স্ত্রী দুজনই সমস্বরে বলে আলহামদুলিল্লাহ আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি।( এতো বেশী সাফার করেছে যে ভালো হওয়ায় আল্লাহ এর কাছে তাদের কৃতজ্ঞতার কোন সীমা নাই।ডা. হিসেবে এই পাওনাটুকুর মূল্য অপরিসীম)

Monday, August 14, 2017

সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল -১২: জাতীয় শোক দিবস " হাচু আপা,হাচু আপা,তোমার আব্বুকে আমি একটু আব্বু বলি?" এবং ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা- ইতিমধ্যে নিহত ৩২

এক
শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা বাংলাদেশে।ইতিমধ্যে  বাংলাদেশ আক্রান্ত। গতরাতেই জানা যায় বন্যার ছোবলে নিহত হয়েছে ৩২ জন।
এই জাতীয় দূর্যোগের সময় সকল রাজনীতি, বিচার নীতি শিকেয় তুলে সরকারের সব সম্পদ  এবং  জনগনের সকল সামর্থ্য নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাড়াতে হবে।( এক যুগ আগেও জাতীয় দূর্যোগের সময় দেখতাম অসংখ্য তরুনদল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দূর্গত মানুষকে সহায়তার জন্য ছুটে যেতো।আজ তারুন্যের সে আদর্শিক চেতনায় মরচে ধরছে কেন?)
ব্যক্তিগত ভাবেও আমাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে

দুই
আজ ১৫ আগষ্ট বাঙ্গালি জাতির কলঙ্কের ও শোকের দিন।
আমি কোন দল করি না( সেটি আমার ধাতের সঙ্গে যায় না), কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমি এক গুন মুগ্ধ ভক্ত।আমার লেখা আত্ম উন্নয়মূলক বই ও সবচেয়ে জনপ্রিয় হওয়া বই " মন ও মানুষ" এর শেষ অধ্যায়ে মনুষত্বের বিকাশ ও বিবর্তনের উপর আলোচনা করতে গিয়ে " সমসাময়িক " মানুষ ও" চিরায়ত/সাত্ত্বিক " মানুষ নিয়ে আলোচনা করি।চিরায়ত মানুষের উদাহরণ দিতে গিয়ে বাঙলাদেশে থেকে একমাত্র বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করেছি( বইটি লিখেছি ২০০৪ সনে- যেটি আওয়ামীলীগ শাসন ছিল না)।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সহ ১৫ আগষ্টে ঘৃন্য হত্যা কান্ডে নিহত সকলের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বঙ্গ বন্ধুর " অসমাপ্ত আত্ম জীবনী" থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ স্মরন করছি :( আমি মনে করি আদর্শিক মুজিবকে স্মরন ও ধারন করা হবে তার প্রতি সম্মান জানানোর সঠিক পন্থা)  :

১।  " বন্ধু বান্ধবরা বলে " তোমার জীবনী লেখ".. সহধর্মিনী বলে " বসেই তো আছো,লিখ তোমার জীবন কাহিনী "। বললাম"... আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোন কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না.."। পৃষ্ঠা-১

( যিনি ১৩ টি বছর জেলে কাটিয়েছেন,শত নির্যাতন সহ্য করে একটি জাতিকে " স্বাধীনতা" উপহার দিয়েছেন,সেই মহান নেতার কত উদারতা " কিছুই তো করতে পারলাম না" বলে আক্ষেপ। অথচ  বর্তমানে অনেকের দাপট ও অহঙ্কার দেখে মনে হয় দেশের জন্য তারা "কত কিছুই না করে ফেলেছেন "।)-
২। ক)হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুই গ্রপের দ্বন্দ্ব মিটমাট করতে বঙ্গবন্ধুকে আনোয়ার সাহেবকে একটি পদ দিতে বলেন।বঙ্গবন্ধু  না বলে দেন।শহীদ  সাহেব তখন বলেন" who are you? you are nobody. "বঙ্গবন্ধু জবাব দিলেন           " if am nobody, then why you invited me? you have no right to insult me.I will prove that I am somebody.. " পৃষ্ঠা-২৯

খ) গোলাম মোহাম্মদ শহীদ সাহেবকে আইন মন্ত্রী করলেন পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য। সবাই এতে ক্ষিপ্ত,বঙ্গবন্ধু ও।শহীদ সাহেব বঙ্গবন্ধুকে করাচী ডেকে নিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেখানে গিয়েও শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন না।পরদিন দেখা হলে শহীদ সাহেব বলেন" রাত্রেই দেখা করা উচিৎ ছিল.."। বঙ্গবন্ধু বললেন ".. আর এসেই বা কি করবো, আপনিতো এখন মোহাম্মদ আলী সাহেবের আইন মন্ত্রী। তিনি বললেন " রাগ করছো।বললাম " রাগ করবো কেন স্যার,ভাবছি সারাজীবন আপনাকে নেতা মেনে ভুলই করেছি কিনা?" পৃষ্ঠা-২৮৬

( সোহরাওয়ার্দীর মতন শীর্ষ নেতাকে মুখের উপর এভাবে উচিত কথা বলতে ওনার বিন্দু মাত্র সংকোচ হয়নি।আর এখন নেতাদের স্তাবকতায় কে বেশি এগিয়ে সে প্রতিযোগিতায় সবাই নেমেছে।অন্য দিকে এরকম প্রতিবাদ করা সত্বেও শহীদ সাহেব বঙ্গবন্ধুকে পরিত্যাগ করেনি বা কোন শাস্তিও দেননি। এখনকার নেতারা তেমন সহনশীল কি?)
৩। " বেকার হোস্টেলে কতগুলো ফ্রি রুম ছিল,গরীব ছাত্রদের জন্য। তখনকার দিনে সত্যিকার যার প্রয়োজন তাকেই তা দেওয়া হতো।.. টেলিফোনে দলীয় ছাত্রদের রুম দেওয়ার অনুরোধ আসতো না"। পৃষ্ঠা-৩৭
(এখন টেলিফোনে দলীয় অনুরোধ না,আদেশ আছে)।

৪। কলকাতায় ১ বছরের মাহিনা বাকী,কাপড় চোপড় কিনতে হবে।বাবা কিছু টাকা দিয়ে বললেন পাকিস্তান আন্দোলন বলে কিছু নাই- কিছু শুনতে চাই না।বিএ পাস ভালোভাবে করতে হবে"। সবার থেকে বিদায় নিয়ে রেনুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাড়িয়ে আছে।"অমঙ্গল অশ্রু জল" বন্ধ করে বললো" একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না।এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ী এস।"( এ যেন এক বিপ্লবী তরুনের রোমান্টিক উপন্যাস) 

৫। " আমার মনে আছে খুবই গরীব এক মহিলা কয়েক ঘন্টা রাস্তায় দাড়িয়ে আছে।শুনেছে এ পথে আমি যাবো।আমাকে দেখে হাত ধরে বললো" বাবা আমার এ কুড়ে ঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।...  খাও বাবা,আর পয়সা কটা তুমি নেও,আমার তো কিছু নেই।" আমার চোখে পানি এলো।.... সেদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম " মানুষেরে ধোকা আমি দিতে পারবো না"।  ( বড় নেতা তিনিই সাধারন,দরিদ্র মানুষ যাকে এভাবে ভালোবাসে এবং এই মহান নেতা কখনো তার জাতিকে তাই ধোকা দেননি।তার আদর্শ বাস্তবায়নের শ্লোগান যাদের তারা কি নেতার এই একটি আদর্শটুকু অন্তত অনুসরন করবেন?)

Sunday, August 13, 2017

সাইকোলজিক্যাল টিপস-৩২: নিজকে বিষ মুক্ত রাখুন

এদের থেকে দূরে থাকুন- যারা

১। মিথ্যা কথা বলে

২। আপনাকে সম্মান করে না

৩। আপনাকে হেয়,তুচ্ছ করতে চায়

৪। আপনাকে সুযোগ পেলেই ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ ও সমালোচনা করে থাকে

( আমি দূরে আছি ও ভালো আছি।আপনিও ট্রাই করে দেখুন)

Tuesday, August 8, 2017

সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল -১১: নাই কাজ তো খই ভাজ/ ভেরেন্ডা ভাজ

আসুন কিছু খই ভাজি
( ২২ শে শ্রাবন ছিল কবিগুরুর প্রয়ান দিবস- কিন্তু  বিশ্ব বন্ধু দিবসের ডামাঢোলে "রবি "অস্তমান অবস্হায়।)
গুরুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে - তারই কিছু বয়ান পরিবেশন করছি(খই ভাজা)

১। সবাই মোরে করেন ডাকাডাকি
  কখন শুনি পরকালের ডাক
সবার আমি সমান বয়সী যে
চুলে আমার যত ধরুক পাক

( চুল পাকলেই মানুষ বৃদ্ধ হয় না- রবি গুরু তো নয়ই, তারুন্য মনের ব্যাপার। আবার চুল পাকলেই জ্ঞানী বা অভিজ্ঞ হয় না, প্রয়োজন জানার,বোঝার ও দেখার মানসিকতা)

২। "ছোট বড়" প্রবন্ধে-

নিজের ধর্মের নামে পশু হত্যা করিব অথচ অন্যে ধর্মের নামে পশু হত্যা করিলে নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব,ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নাম দেওয়া যায় না

( কিন্তু পশু হত্যার কারনে নর হত্যা আজও বিদ্যমান।আমরা  কবে কবি গুরুর  এরকম অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করবো?)

৩। মনুষ্যত্বের অপমানে বিধাতার কাছে তীব্র অভিযোগ -

আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা
                       কপট রাত্রি ছায়ে
                        হেনেছে নিঃসহায়ে
আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন
                       শক্তের অপরাধে
বিচারের বানী নিরবে নিভৃতে কাদে

( বিশ্বজিৎ হত্যার মামলা সহ হাজার হাজার বিচারের বানী আরো কতদিন নিরবে নিভৃতে কাদবে?বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্য ধর্ষন সহ সব ধরনের অপরাধ দেশে বেড়েই চলছে)

৪। সোনার তরীর "পুরস্কার "কবিতা থেকে

সংসার মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাবো করিয়া মধুর
দু'একটি কাটা করি দিব দূর
       তারপর ছুটি নিব

(দেশ, সমাজ,মানুষের পথের ক'টি কাটা দূর করেছি? ক'টি সুর বাধতে পেরেছি যা নিজ জীবন ও মানব জীবনকে  করে তুলবে মধুর করে?এই মহান কবির প্রয়ান দিবসের প্রতিজ্ঞা হোক- অন্তত সমাজ জীবনের কয়েকটি কাটা,জন্জাল দূর করবো; অন্তত কয়েকটি কল্যাণ মূলক কাজ, সৃজনশীল নির্মাণ করে যাবো যা নিজ জীবনকে তো বটে,সমাজ ও বৃহত্তর মানব জীবনকে মধুর করবে)

Tuesday, August 1, 2017

ধর্ষন সংস্কৃতির উৎসব: থামাবে কে?

দিল্লীতে ৫ বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষনের পর সারভাইভাল অব চাইল্ড এবিউজ এর প্রতিষ্ঠান রাহী ফাউন্ডেশন এর কাউন্সেলর আনজু গুপ্তা বলেন" ভেদিক ( vedic) সংস্কৃতি থেকে ভারত এখন " ধর্ষন সংস্কৃতির" জন্য পৃথিবী ব্যাপী পরিচিতি পাচ্ছে।"
আমরা কি এ সংস্কৃতি চর্চায় কোন অংশে পিছিয়ে আছি? তুফান সরকারের ক্ষমতা মত্ত পাশবিক ধর্ষন এবং পরে মেয়ে ও  মাকে প্রকাশ্যে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনা তুফান বেগে জন মানসে তৈরী তোলপাড় স্তিমিত হতে না হতেই শিপন নামক নর পশু কর্তৃক সাড়ে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষন করে মেরে ফেলার ভয়ঙ্কর সংবাদ জাতি পায়।এর ও রেশ কাটতে না কাটতে চট্টগ্রামে আরেক শিশু ধর্ষনকারীকে গ্রপ্তার করার কথা জানা গেলো।আর ফিরিস্তি না বাড়িয়ে বলা যায় প্রতিদিনই অসংখ্য  নারী ধর্ষিতা হচ্ছে  এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হচ্ছে শিশু।
আমরা ধর্ষনকে "  সেক্সুয়ালাইজড "করে থাকি,অথচ এটিকে করতে হবে "ক্রিমিনালাইজড"। এটি একান্তই একটি অপরাধ, নারীর প্রতি সহিংসতা।
ধর্ষনের শ্রেনি বিভাগ:
পরিস্হিতি অনুযায়ী :অভিসার/ দাওয়াত ধর্ষন,(বনানীর ধর্ষন), শিশু ধর্ষন, জেলখানায় ধর্ষন,পরিচিতজন দ্বারা ধর্ষন( বেশীরভাগ  ধর্ষন এ পর্যায়ের),সম্মতি দেওয়ার বয়স হয়নি তেমন বালিকা ধর্ষন, দলবদ্ধ ধর্ষন,দাম্পত্য ধর্ষন,নিকটাত্মীয় দ্বারা  ধর্ষন( আপন পিতা নিজ কন্যাকে আটকে রেখে বহু বছর ধর্ষনের কথা পত্রিকায় এসেছে)- ইত্যাদি।

২।ধর্ষকের লক্ষ্য অনুযায়ী:
ক্রুদ্ধ ধর্ষক( এনগার রেপিস্ট); ক্ষমতা দেখানো ধর্ষক( পাওয়ার রেপিস্ট- বেশীরভাগ ধর্ষক এ শ্রেনীর); ও পীড়নকারী ধর্ষক( স্যাডিস্ট রেপিস্ট)

।সাধারনভাবে ধর্ষনের মনো- সামাজিক- আর্থিক দিক ও এর প্রতিকার নিয়ে কম বেশি আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে।কিন্তু শিশু ধর্ষনের মতন ঘৃন্য,বিভৎস্য ঘটনা নিয়ে আলাদা আলোচনা তেমন হচ্ছে না।

অথচ প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে শিশুরা ৩ গুন বেশী ধর্ষনের শিকার হন।দক্ষিণ আফ্রিকায় শিশু ধর্ষন প্রায় মহামারির আকার ধারন করেছে।সে জন্য আফ্রিকায় এই নরপশুদের শাস্তি দেওয়া হয় এদেরকে হাত বেধে উপর থেকে ঝুলিয়ে অন্ডকোষে বড় পাথর বেধে সেটি ঝুলিয়ে রেখে।

মার্কিন গবেষক সান্ডার ও তার সহযোগীদের গবেষণায় দেখা যায় প্রতি হাজারে ৮৫ জন শিশু ধর্ষিত হয়।এদের গড় বয়স ১০.৮৪ বছর।এর মধ্যে জন্ম থেকে( ৮ মাসের শিশুকেও ধর্ষনের ইতিহাস আছে) ৭ বছরের মধ্যে ধর্ষিত হয় ২১.৫%;৭-১২ বছরের মধ্যে ধর্ষিত হয় ৩৮.৩% ও ১২-১৭ বছরের মধ্যে ধর্ষিত হয় ৪২.২%। তাই শিশু ধর্ষন সব দেশেই একটি বড় সমস্যা।

চেম্বারে ১৪ বছরের এক রোগিণী বিভিন্ন মনো- দৈহিক সমস্যা নিয়ে আসেন।এক পর্যায়ে সে বলে " স্যার,কেবল আমি-ই কেন?( হোয়াই মি অনলি?)। মেয়েটি শৈশব থেকে বহু ঘনিষ্ঠ জন দ্বারা বার বার লান্চিত হয়েছে।তীব্র ঘৃনা ও ক্ষোভে নিজকে ধিক্কার দিচ্ছে - আমি-ই কেন? সে জানে না সে একা নয়,এরকম বর্বরতার শিকার অনেক নারী।

ঘনিষ্ঠ আত্মীয়- স্বজন দ্বারা এরকম কুৎসিত কাজকে বলা হয় "ইনসেস্ট" ( বাবা কর্তৃক ও মায়ের সম্মতিতে মেয়েকে দীর্ঘ দিন ধর্ষন করার কাহিনী তো এই সেদিনের)। ঐ মেয়ের মতন বহু মেয়ের আর্তনাদ, ক্ষোভ,ঘৃনা তাদের মনে চাপা পড়ে আছে যার খোজ এমনকি তাদের মা- বাবাও জানে না।

এই মানব রূপী পশুদের বৈশিষ্ট্য কি?

এরা যৌন বিকৃতিরও মনো বিকৃতির শিকার; এদের শিশুকাল থেকে ছোট- বড় অপরাধ করার ইতিহাস থাকে; এদের অনেকেই মা- বাবার ভাঙ্গা সংসার বা অকার্যকর সংসার থেকে আগত: এরা  বাউন্ডেলে,উদ্দেশহীন ঘুরে বেড়ানো,উচ্ছৃঙ্খল ; এরা বিবেকবোধ হীন; এরা অপরাধ করে অনুতপ্ত হয় না; এরা নিষ্ঠুর, নির্মম ; এরা শিশুর অসহায়ত্ব ও তীব্র বেদনা দেখে আনন্দ পায়; এরা নিয়ন্ত্রণ হীন পশুর মতন।
সমাজ বিজ্ঞানে বলা  হয় ক্ষমতা ও অপরাধের ধরন সংক্রামক। এরকম এক তত্বে বলা হয় এরা শৈশবে দেখে বাবা মাকে মারছে,নির্যাতিতা মা তার আক্রোশ ঝাড়ছে সন্তানের উপর, সে সন্তান তার বিকৃতি ও নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ করছে অসহায়,দুর্বল শিশুর উপর। এদের মনোজগতে এক ধরনের " শুন্যতা" তৈরি হয়,যে শুন্যতা তারা কোনভাবে পূরন করতে চায়।বয়: সন্ধিকালে হরমোনের জোয়ার; সুপার ইগো বা বিবকের অনুপস্হিতি;শৈশব থেকে অপরাধে হাতে খড়ি ও নির্মম, নিষ্ঠুর মনো গঠনের কারনে এরা যৌনতাকে " ক্ষমতার" অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।  তাদের ধর্ষন তাই যৌন লালসা কেন্দ্রিক  নয়,এটি ক্ষমতা কেন্দ্রিক( ৩-৫ বছরের শিশুর মধ্যে যৌন আকর্ষণ বা যৌন তৃপ্তির আদৌ কি কিছু থাকে?)।

আনজু গুপ্তা আরো বলেন " শিশু ধর্ষন একটি কমপালসিভ আচরন"- যা তাড়নাবশত বাধ্যতামূলক এবং এরা এই ঘৃন্য কাজ বার বার করে থাকে"।
সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন যে সমাজ ও পরিবারে বিচ্যুত, বখাটে আচরনকে দেখে ও না দেখার ভান করা হয় সেখানে অপরাধের সংখ্যা বাড়ে।তেমনি  যে সমাজে বখাটেপনাকে নিয়ন্ত্রণে ভালো,কার্যকর সামাজিক মেকানিজম থাকে এবং কার্য উপযোগী আইনী ব্যবস্থা থাকে সেখানে অপরাধ প্রবনতা দমিত থাকে।

আরো বলা হয় যে সমাজে পুলিশ প্রশাসন অপরাধ করার পূর্বেই অপরাধীদের দমন করতে প্রো- একটিভ তৎপরতা দেখায় সেখানে রাতা রাতি অপরাধ কমে যায়।আমাদের পরিবার,সমাজ,আইনি কাঠামো ও পুলিশ প্রশাসনে কি এরকম প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা বিদ্যমান? 
সমাজতাত্ত্বিক আরেকটি মূল্যায়ন হচ্ছে আমাদের সমাজ দ্রত রূপান্তরিত হচ্ছে।এতে পুরনো মূল্য বোধ ভেঙ্গে পড়ছে অথচ নতুন মূল্য বোধ তৈরী হচ্ছে না বা হলে ও সে নতুন মূল্য বোধের সঙ্গে কেউ কেউ খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। ফলে কিছু তরুন তরুনী সমাজচ্যুত হয়ে পড়ছে ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।তাই পুরনো মূল্য বোধ ফিরিয়ে আনতে হবে অথবা নতুন মূল্য বোধের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার দক্ষতা তৈরি করতে হবে।
এক সময় যে সামাজিক ও পারিবারিক শক্তি ও মেকানিজম আমাদের সমাজে অপরাধ দমিয়ে  রাখতো সেটি এখন অকার্যকর। সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে ও কার্যকর করতে হবে।
ধর্ষন বিশেষ করে শিশু ধর্ষন হচ্ছে সমাজের " এইডস" রোগ।একবার কোন সমাজে এ রোগ ছড়িয়ে পড়লে দ্রত সে সমাজ মরে যাবে।সমাজের এই মরন ব্যাধিকে এখনি রুখতে হবে।

সবশেষে গার্জিয়ানদের সতর্ক থাকতে হবে ও খোজ নিতে হবে তাদের আদরের কন্যা সন্তানটি তেমন জগন্য ঘটনার শিকার হবে কিনা বা ইতিমধ্যে হয়েছে কিনা।

যে ভাবে বুঝবেন: ক্ষুধা কমে যাবে; প্রায়ই উদাসীন থাকবে; গোসল করানোর সময় কাপড় খুলতে গেলে ভয় পাবে; বিশেষ ব্যক্তিকে দেখলে অস্বস্তি বোধ করবে; বা শরীরে আচড়,আঘাতজনিত কাল শিরে পড়া।

মনে রাখবেন এই শারিরীক দাগ একদিন মুছে যাবে কিন্তু তার মন- আত্মায় যে অমোচনীয় দাগ তা কোন দিন মুছবে না।তাই পরে আফসোস করার চেয়ে কন্যা সন্তানকে পূর্ব থেকে নিরাপদ রাখা উত্তম
 
প্রফেসর ডা. তাজুল ইসলাম
সোশাল সাইকিয়াট্রিস্ট
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কমিউনিটি এন্ড সোশাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল,ঢাকা।
e- mail: drtazul84@gmail.com
mob:01715112900