দিল্লীতে ৫ বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষনের পর সারভাইভাল অব চাইল্ড এবিউজ এর প্রতিষ্ঠান রাহী ফাউন্ডেশন এর কাউন্সেলর আনজু গুপ্তা বলেন" ভেদিক ( vedic) সংস্কৃতি থেকে ভারত এখন " ধর্ষন সংস্কৃতির" জন্য পৃথিবী ব্যাপী পরিচিতি পাচ্ছে।"
আমরা কি এ সংস্কৃতি চর্চায় কোন অংশে পিছিয়ে আছি? তুফান সরকারের ক্ষমতা মত্ত পাশবিক ধর্ষন এবং পরে মেয়ে ও মাকে প্রকাশ্যে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনা তুফান বেগে জন মানসে তৈরী তোলপাড় স্তিমিত হতে না হতেই শিপন নামক নর পশু কর্তৃক সাড়ে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষন করে মেরে ফেলার ভয়ঙ্কর সংবাদ জাতি পায়।এর ও রেশ কাটতে না কাটতে চট্টগ্রামে আরেক শিশু ধর্ষনকারীকে গ্রপ্তার করার কথা জানা গেলো।আর ফিরিস্তি না বাড়িয়ে বলা যায় প্রতিদিনই অসংখ্য নারী ধর্ষিতা হচ্ছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হচ্ছে শিশু।
আমরা ধর্ষনকে " সেক্সুয়ালাইজড "করে থাকি,অথচ এটিকে করতে হবে "ক্রিমিনালাইজড"। এটি একান্তই একটি অপরাধ, নারীর প্রতি সহিংসতা।
ধর্ষনের শ্রেনি বিভাগ:
পরিস্হিতি অনুযায়ী :অভিসার/ দাওয়াত ধর্ষন,(বনানীর ধর্ষন), শিশু ধর্ষন, জেলখানায় ধর্ষন,পরিচিতজন দ্বারা ধর্ষন( বেশীরভাগ ধর্ষন এ পর্যায়ের),সম্মতি দেওয়ার বয়স হয়নি তেমন বালিকা ধর্ষন, দলবদ্ধ ধর্ষন,দাম্পত্য ধর্ষন,নিকটাত্মীয় দ্বারা ধর্ষন( আপন পিতা নিজ কন্যাকে আটকে রেখে বহু বছর ধর্ষনের কথা পত্রিকায় এসেছে)- ইত্যাদি।
২।ধর্ষকের লক্ষ্য অনুযায়ী:
ক্রুদ্ধ ধর্ষক( এনগার রেপিস্ট); ক্ষমতা দেখানো ধর্ষক( পাওয়ার রেপিস্ট- বেশীরভাগ ধর্ষক এ শ্রেনীর); ও পীড়নকারী ধর্ষক( স্যাডিস্ট রেপিস্ট)
।সাধারনভাবে ধর্ষনের মনো- সামাজিক- আর্থিক দিক ও এর প্রতিকার নিয়ে কম বেশি আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে।কিন্তু শিশু ধর্ষনের মতন ঘৃন্য,বিভৎস্য ঘটনা নিয়ে আলাদা আলোচনা তেমন হচ্ছে না।
অথচ প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে শিশুরা ৩ গুন বেশী ধর্ষনের শিকার হন।দক্ষিণ আফ্রিকায় শিশু ধর্ষন প্রায় মহামারির আকার ধারন করেছে।সে জন্য আফ্রিকায় এই নরপশুদের শাস্তি দেওয়া হয় এদেরকে হাত বেধে উপর থেকে ঝুলিয়ে অন্ডকোষে বড় পাথর বেধে সেটি ঝুলিয়ে রেখে।
মার্কিন গবেষক সান্ডার ও তার সহযোগীদের গবেষণায় দেখা যায় প্রতি হাজারে ৮৫ জন শিশু ধর্ষিত হয়।এদের গড় বয়স ১০.৮৪ বছর।এর মধ্যে জন্ম থেকে( ৮ মাসের শিশুকেও ধর্ষনের ইতিহাস আছে) ৭ বছরের মধ্যে ধর্ষিত হয় ২১.৫%;৭-১২ বছরের মধ্যে ধর্ষিত হয় ৩৮.৩% ও ১২-১৭ বছরের মধ্যে ধর্ষিত হয় ৪২.২%। তাই শিশু ধর্ষন সব দেশেই একটি বড় সমস্যা।
চেম্বারে ১৪ বছরের এক রোগিণী বিভিন্ন মনো- দৈহিক সমস্যা নিয়ে আসেন।এক পর্যায়ে সে বলে " স্যার,কেবল আমি-ই কেন?( হোয়াই মি অনলি?)। মেয়েটি শৈশব থেকে বহু ঘনিষ্ঠ জন দ্বারা বার বার লান্চিত হয়েছে।তীব্র ঘৃনা ও ক্ষোভে নিজকে ধিক্কার দিচ্ছে - আমি-ই কেন? সে জানে না সে একা নয়,এরকম বর্বরতার শিকার অনেক নারী।
ঘনিষ্ঠ আত্মীয়- স্বজন দ্বারা এরকম কুৎসিত কাজকে বলা হয় "ইনসেস্ট" ( বাবা কর্তৃক ও মায়ের সম্মতিতে মেয়েকে দীর্ঘ দিন ধর্ষন করার কাহিনী তো এই সেদিনের)। ঐ মেয়ের মতন বহু মেয়ের আর্তনাদ, ক্ষোভ,ঘৃনা তাদের মনে চাপা পড়ে আছে যার খোজ এমনকি তাদের মা- বাবাও জানে না।
এই মানব রূপী পশুদের বৈশিষ্ট্য কি?
এরা যৌন বিকৃতিরও মনো বিকৃতির শিকার; এদের শিশুকাল থেকে ছোট- বড় অপরাধ করার ইতিহাস থাকে; এদের অনেকেই মা- বাবার ভাঙ্গা সংসার বা অকার্যকর সংসার থেকে আগত: এরা বাউন্ডেলে,উদ্দেশহীন ঘুরে বেড়ানো,উচ্ছৃঙ্খল ; এরা বিবেকবোধ হীন; এরা অপরাধ করে অনুতপ্ত হয় না; এরা নিষ্ঠুর, নির্মম ; এরা শিশুর অসহায়ত্ব ও তীব্র বেদনা দেখে আনন্দ পায়; এরা নিয়ন্ত্রণ হীন পশুর মতন।
সমাজ বিজ্ঞানে বলা হয় ক্ষমতা ও অপরাধের ধরন সংক্রামক। এরকম এক তত্বে বলা হয় এরা শৈশবে দেখে বাবা মাকে মারছে,নির্যাতিতা মা তার আক্রোশ ঝাড়ছে সন্তানের উপর, সে সন্তান তার বিকৃতি ও নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ করছে অসহায়,দুর্বল শিশুর উপর। এদের মনোজগতে এক ধরনের " শুন্যতা" তৈরি হয়,যে শুন্যতা তারা কোনভাবে পূরন করতে চায়।বয়: সন্ধিকালে হরমোনের জোয়ার; সুপার ইগো বা বিবকের অনুপস্হিতি;শৈশব থেকে অপরাধে হাতে খড়ি ও নির্মম, নিষ্ঠুর মনো গঠনের কারনে এরা যৌনতাকে " ক্ষমতার" অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের ধর্ষন তাই যৌন লালসা কেন্দ্রিক নয়,এটি ক্ষমতা কেন্দ্রিক( ৩-৫ বছরের শিশুর মধ্যে যৌন আকর্ষণ বা যৌন তৃপ্তির আদৌ কি কিছু থাকে?)।
আনজু গুপ্তা আরো বলেন " শিশু ধর্ষন একটি কমপালসিভ আচরন"- যা তাড়নাবশত বাধ্যতামূলক এবং এরা এই ঘৃন্য কাজ বার বার করে থাকে"।
সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন যে সমাজ ও পরিবারে বিচ্যুত, বখাটে আচরনকে দেখে ও না দেখার ভান করা হয় সেখানে অপরাধের সংখ্যা বাড়ে।তেমনি যে সমাজে বখাটেপনাকে নিয়ন্ত্রণে ভালো,কার্যকর সামাজিক মেকানিজম থাকে এবং কার্য উপযোগী আইনী ব্যবস্থা থাকে সেখানে অপরাধ প্রবনতা দমিত থাকে।
আরো বলা হয় যে সমাজে পুলিশ প্রশাসন অপরাধ করার পূর্বেই অপরাধীদের দমন করতে প্রো- একটিভ তৎপরতা দেখায় সেখানে রাতা রাতি অপরাধ কমে যায়।আমাদের পরিবার,সমাজ,আইনি কাঠামো ও পুলিশ প্রশাসনে কি এরকম প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা বিদ্যমান?
সমাজতাত্ত্বিক আরেকটি মূল্যায়ন হচ্ছে আমাদের সমাজ দ্রত রূপান্তরিত হচ্ছে।এতে পুরনো মূল্য বোধ ভেঙ্গে পড়ছে অথচ নতুন মূল্য বোধ তৈরী হচ্ছে না বা হলে ও সে নতুন মূল্য বোধের সঙ্গে কেউ কেউ খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। ফলে কিছু তরুন তরুনী সমাজচ্যুত হয়ে পড়ছে ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।তাই পুরনো মূল্য বোধ ফিরিয়ে আনতে হবে অথবা নতুন মূল্য বোধের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার দক্ষতা তৈরি করতে হবে।
এক সময় যে সামাজিক ও পারিবারিক শক্তি ও মেকানিজম আমাদের সমাজে অপরাধ দমিয়ে রাখতো সেটি এখন অকার্যকর। সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে ও কার্যকর করতে হবে।
ধর্ষন বিশেষ করে শিশু ধর্ষন হচ্ছে সমাজের " এইডস" রোগ।একবার কোন সমাজে এ রোগ ছড়িয়ে পড়লে দ্রত সে সমাজ মরে যাবে।সমাজের এই মরন ব্যাধিকে এখনি রুখতে হবে।
সবশেষে গার্জিয়ানদের সতর্ক থাকতে হবে ও খোজ নিতে হবে তাদের আদরের কন্যা সন্তানটি তেমন জগন্য ঘটনার শিকার হবে কিনা বা ইতিমধ্যে হয়েছে কিনা।
যে ভাবে বুঝবেন: ক্ষুধা কমে যাবে; প্রায়ই উদাসীন থাকবে; গোসল করানোর সময় কাপড় খুলতে গেলে ভয় পাবে; বিশেষ ব্যক্তিকে দেখলে অস্বস্তি বোধ করবে; বা শরীরে আচড়,আঘাতজনিত কাল শিরে পড়া।
মনে রাখবেন এই শারিরীক দাগ একদিন মুছে যাবে কিন্তু তার মন- আত্মায় যে অমোচনীয় দাগ তা কোন দিন মুছবে না।তাই পরে আফসোস করার চেয়ে কন্যা সন্তানকে পূর্ব থেকে নিরাপদ রাখা উত্তম।
প্রফেসর ডা. তাজুল ইসলাম
সোশাল সাইকিয়াট্রিস্ট
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কমিউনিটি এন্ড সোশাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল,ঢাকা।
e- mail: drtazul84@gmail.com
mob:01715112900
No comments:
Post a Comment