কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের এক ছাত্র ১১ বার ফেল করায়, হতাশার কারনে আত্মহত্যা করার বিষয়ে, সামাজিক গন মাধ্যমে কয়েকটি পোস্ট ও তাতে অসংখ্য ডাক্তারের মন্তব্য অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।মেডিকেলের একজন সিনিয়র শিক্ষক ও সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে এ বিষয়ে কিছু বলা কর্তব্য মনে করছি।
মেডিকেল শিক্ষা, তার মান, অধগতি ও অগ্রগতি নিয়ে বিশ্লেষণাত্বক অনেক কিছু বলার ছিল,
তবে এবার বৃহৎ ক্যাম্পাসে বক্তব্য না দিয়ে সংক্ষেপে কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করবো।
মোটা দাগে এগুলো কি অস্বীকার করা যাবে যে
১। মেডিকেল শিক্ষার গুনগত মান ক্রমশ কমছে?
২। ব্যক্তি স্বার্থে,গোষ্ঠী স্বার্থে নিছক বানিজ্যিক কারনে যত্রতত্র মেডিকেল কলেজ খোলা হয়েছে,হচ্ছে?
এবং
৩। বিভিন্ন পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী বিকেন্দ্রীকরণের নামে এমন স্হানে ও কি নেওয়া হয়নি যেখানে এমবিবিএস পড়ানোর ও মতন লোকবল নেই?
৪। ভর্তি থেকে পাশ করা,পরে পদ ও বদলী,প্রমোশন,শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ,পরে কোন শিক্ষক পরীক্ষক হবে- ইত্যাদি প্রায় সব ব্যাপারে দলীয়,গোষ্ঠী গত বিবেচনা কি ক্রমশ বাড়েনি?
এসবের সবচেয়ে বড় কুফল হচ্ছে মেডিকেল পরীক্ষা পদ্ধতিতে অরগানাইজড গোষ্ঠী তন্ত্রের সৃষ্টি
আমার বিবেচনায় শিক্ষকরা হচ্ছেন মা- বাবার মতন।
তারা সন্তানের ন্যায় ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ভালো ফলাফলের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সবরকমের চেষ্টা ও যত্ম নেবেন
।কোনভাবেই পড়ালেখায় কোন গাফিলতি মেনে নেবেন না।আমরা কত জন সেভাবে তাদের তত্বাবধান ও প্রয়োজনীয় শাসনে রাখি?
তবে সেই শিক্ষকরাই যখন" পরীক্ষক" হন তারা হবেন" বিচারকদের" মতন,যারা পরীক্ষা নেবেন ন্যায় বিচারকের মতন।
কিছু অনৈতিক,বিবেকহীন মা- বাবা যেমন প্রয়োজনে নিজেরা টাকা দিয়ে ফাস করা প্রশ্ন কিনে সন্তানদের হাতে তুলে দেন জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য, আমরা শিক্ষকরাও কি আমার ছাত্র, আমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র বলে তাদেরকে " বিশেষ বিবেচনায়" পাশ করিয়ে দেওয়ার অনৈতিক পন্হা গ্রহন করতে পারি?
পরীক্ষকরা বিচার করবে( পরীক্ষা নিবে) অন্ধভাবে- কে আমার ছাত্র,আমার পক্ষের,আমার ফলোয়ার,আমার দলের/ গোষ্ঠীর,আমাকে তোয়াজ/ তেল দিয়ে চলে- ইত্যাদি বিবেচনা না করে।
কিন্তু বর্তমানে অনেক ছাত্র ছাত্রী ( সবাই না)যারা পরীক্ষক হন শুধু তাদের ক্লাশ করেন,তাদের রাউন্ডে ঘুরেন। হাইলি একাডেমীক,গবেষক, প্রাজ্ঞ শিক্ষক যদি পরীক্ষক না হন, তাহলে তারা তাদের এড়িয়ে চলেন,তাদের ক্লাশে হাজির হওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না।
এরকম হওয়ার কারন,কোন কোন প্রতিষ্ঠানে( সব জায়গায় নয়) মেডিকেল পরীক্ষা পদ্ধতি ২-৩ জনের কৌশলী ব্যবস্হাপনার অধীনে চলে গেছে।কারা পরীক্ষক হবে,খাতা দেখবে,প্রাকটিকেল নেবে,ভাইবা নেবে এবং এসবের পারমুটেশন,কম্বিনেশন কেমন হবে- ইত্যাদি পদ্ধতি ঐ ২-৩ জনের হাতে জিম্মি। ফলে অন্য পরীক্ষকরা পাশ করালেও তারা ফেল করিয়ে দিতে পারে, আবার কাউকে জেনিউন ফেল করালেও তাদের তৈরি সিস্টেমের কারনে নিশ্চিত পাশ করিয়ে দিতে পারে।
এই যে কারো কাছে নিশ্চিত " পাশ" বা ফেল এর চাবিকাঠি রয়েছে- এ জন্য সকল ছাত্র ছাত্রী তাদের অনুগত,তাঁবেদারি করাকে কর্তব্য জ্ঞান করে।
বাংলাদেশে এফসিপিএস পরীক্ষা এখনো অনেক উন্নত মান ধরে রেখেছে।তবে এতে পাশের হার ৩%-৫% হয় বলে প্রশ্ন উঠেছে এই পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে কোন ইনবিল্ড ক্রটি রয়েছে কিনা বা শিক্ষকদের দৃষ্টি ভঙ্গিতে কাঠিন্য বা অবিবেচনা কাজ করছে কিনা।শুনেছি বিসিপিএস এ সব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে ও আরো প্রাগমেটিক,বিজ্ঞান সম্মত,ক্রটিমুক্ত পদ্ধতি বের করার চেষ্টা করছে।কিন্তু পরীক্ষক নির্বাচনে এখনো পদ্ধতি গত এবং বুর্জোয়া আধিপত্যের অভিযোগ রয়েছে। এখনো বিশেষ কিছু ব্যক্তিদের চয়েজ ও পরামর্শে পরীক্ষক প্যানেল তৈরি করা হয়।উনারা অনেকেই গুনী ও সিনিয়র।কিন্তু এরকম ব্যবস্হাপনায় নিজস্ব পছন্দ, অনুগত ব্যক্তিদের বার বার নিয়োগ দেওয়ার প্রবনতা তৈরি হতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ও। তাছাড়া সেখানে এমন কিছু নিয়ম,রীতি রয়েছে যেগুলোর কারনে অনেক যোগ্য অধ্যাপককে পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না।তাই যোগ্য শিক্ষকদের পরীক্ষক করার জন্য ঐসব আইনে পরিবর্তন আনা দরকার এবং পরীক্ষক হওয়ার যোগ্য সকল শ্রেনীর শিক্ষকদের উন্মুক্ত আলোচনা ও মতামতের মাধ্যমে পরীক্ষক প্যানেল তৈরি করলে এর একটি গ্রহনযোগ্য ও গনতান্ত্রিক সমাধান হতে পারে।
এম ডি,এম এস পদ্ধতি নতুন হলেও দুরুত ডাক্তার ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে । একটি কারন এখানে মাসিক হারে কিছু টাকা দেওয়া হয় এবং কিছু বিভাগে( সব নয়) এ ধারনা তৈরি করা হয়েছে যে একবার ভর্তি হতে পারলে পাশ সুনিশ্চিত। অনেকের অভিযোগ এখানকার ভর্তি সিস্টেমে অনৈতিক প্রভাবে অনেক ছাত্র ছাত্রীকে ভর্তি করিয়ে নেওয়া হয়( তবে সব নয়)।
এখানে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কোর্স পরিচালনার জন্য একটি পরিষদ তৈরি করা হয়।এই পরিচালনা পর্ষদে কারা থাকবেন ও তারা নিজ প্রতিষ্ঠানে কাদের পরীক্ষক নিয়োগ করবে- এই উভয় ক্ষেত্রে রয়েছে গোষ্ঠী গত বিবেচনার সুযোগ এবং কিছু ক্ষেত্রে তেমন অভিযোগ উঠছে।কিন্তু প্রতিকারের জন্য উচ্চ পর্যায়ে এরকম অভিযোগ নিয়ে যাওয়া কঠিন।এমন কমিটিও গঠিত হয়েছে যেখানে সিনিয়র, একাডেমীক,যোগ্য প্রফেসরদের বাদ দিয়ে খুবই জুনিয়র মাত্র ছাত্রত্ব কেটেছে তেমন কাউকে কমিটির উচ্চতর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই তেমন কমিটি সিনিয়র, উপযুক্ত শিক্ষকদের নানান ওছিলায় পরীক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে রেখে পছন্দনীয় জুনিয়রদের দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছেন।এমনকি শ্রেষ্ঠা বিদ্যা পিঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সাবজেক্টে ও বছরের পর বছর পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে অনেক সিনিয়র, যোগ্য শিক্ষক বাদ রেখে,নিজেদের গুটিকয়েক " বাছাইকৃত" শিক্ষক দিয়ে। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি দিয়ে যাচাই করলে এসবের সত্যতা নিশ্চিত করা যাবে।
যারা বার বার ফেল করে আমি নির্দ্বিধায় বলবো এরা হচ্ছে বর্তমান সমাজে সবচেয়ে দুর্বল শ্রেনীর লোক।এরা ঐ গরিষ্ঠ চতুর ছাত্র ছাত্রীদের মতন ঐ পরীক্ষায় "নিশ্চিত পাশ" করে দেওয়া শক্তিকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মতন চালাক- চতুর নয়,বা কোন দল,গোষ্ঠীর অনুগত নয়, এমনকি ব্যক্তিগত মাস্তানি করার মতন সাহসী (?) ও নয়।
এক কথায় তারা দুর্বলতম, তাই কোন পক্ষই তাদের কথা বিবেচনায় রাখে না।
এর মানে এই নয় যে ফেল করাদেরকে পাশ করিয়ে দিতে হবে। কিন্তু
১১ বার ফেল করলে সে বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান কি এ বিষয়টি এড়িয়ে থাকতে পারে? ১ বা২ বার ফেল করা আর প্রতিবার ফেল করাকে সমদৃষ্টিতে দেখার কি সুযোগ আছে?
বার বার ফেল করার কারন,তাদের দুর্বলতা গুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে বসা কি জরুরি নয়?
তাদের দুর্বল দিক কাটানোর জন্য একাডেমীক ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া কি অত্যাবশ্যক নয়?
তাই আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব:
১। যারা বার বার ফেল করবে প্রতিটি বিভাগ/ প্রতিষ্ঠান তাদের জন্য একটি "একাডেমীক সেল" তৈরি করবে,যারা তাদের দুর্বলতা গুলো চিন্নিত করবে ও সে সব কাটিয়ে উঠার জন্য একাডেমীক কার্যক্রম গ্রহন করবে।
২। প্রতিটি সাইকিয়াট্রি বিভাগে নিজ প্রতিষ্ঠানের ফেল করা ছাত্র সহ,মানসিক সমস্যা, হতাশা,বিষন্নতায় ভোগা ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আলাদা " বিশেষ সেবা" দানের জন্য একটি করে " টিম" গঠন করবে
আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি,"নিশ্চিত পাশের" বদৌলতে যে সব অযোগ্যরা অনায়াসে পাশ করে বের হয়ে যাচ্ছে, তাদের তুলনায় ফেল করা ছাত্ররা,বিশেষ কার্যক্রমে উপযুক্ত হয়ে পাশ করে বের হলে তারা অধিকতর মানবিক ও দক্ষ ডাক্তার হয়ে উঠবে
প্রফেসর ডা. মো. তাজুল ইসলাম
মনোরেোগ বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কমিউনিটি এন্ড সোশাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল,ঢাকা
ই- মেইল:drtazul84@gmail.com
phone :01715112900
No comments:
Post a Comment