Thursday, November 29, 2018

রোগ কাহিনী -৪৮ঃযে রোগী নিজেই নিজের কাউন্সিলিং করে সুস্থ হয়েছেন

( আজ একই দলের দুই ভাইয়ের ক্ষমতার দ্বন্ধে প্রান হারানো এক কর্মির সংসারে কিভাবে নরক নেমে এসেছে সে নিয়ে রোগ কাহিনী লিখতে চেয়েছিলাম।কিন্তু দেশ এখন নির্বাচন জ্বরে আক্রান্ত। এমন সময়ে রাজনীতি বিষয়ক কোন পোস্ট না দেওয়াই শ্রেয় মনে করছি)।

সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল -২৮ এ আমি আমার বই " মন ও মানুষ " পড়ে কিভাবে এক রোগী নিজের "বোধ, বুদ্ধি, চিন্তা, উপলব্ধি " পরিবর্তন করে নিজের দীর্ঘদিনের অসুস্হতা ভাল করেছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলাম।

সেখানে তিনি কিভাবে ঐ বইয়ের সাহায্যে  " কগনেটিভ বিহেইভিয়ার থেরাপি " ব্যবহার করে নিজের মনোজগতে পরিবর্তন এনেছিলেন, তা উদাহরণসহ বর্ননা করেছি।

পরে ওনার রোগ কাহিনী লিখবো বলেছিলাম। আজ শুনুন সে কাহিনী।

কাহিনী সংক্ষেপঃ
মি. কামাল বয়স ৪৮ বছর। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পরিবারের বড় ছেলে। তাকে মাদ্রাসায় পড়তে দেওয়া হয়।কিন্তু তিনি সেটি পছন্দ করতেন না,কানাকাটি করতেন।

পরে সাধারন স্কুলে চলে আছেন। আর্থিক সঙ্কটের কারনে ছোট বয়সেই ৪-৫ বার স্কুল বাদ দিতে হয়েছে। কিন্তু পড়ার জন্য তার প্রচন্ড আগ্রহ। তার ভাষায়- আমাকে পড়তেই হবে।

৮ মাস স্কুলে যাইনি। পরের ২ মাস অন্যের বই পড়ে পরীক্ষা দেই এবং ভাল ভাবে পাশ করি (উনি যে সত্যি মেধাবী তার প্রমাণ আমার বই অনেকে পড়েছে ও খুব ভাল লেগেছে, উপকার পেয়েছে বলেছে। কিন্তু "কগনেটিভ বিহেইভিয়ার থেরাপি " এর মতন কঠিন বিষয়টি যা উচ্চ শিক্ষিত অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও তত বেশি আত্মস্থ করতে পারেন না,তিনি মনোজগতের সেই কঠিন, রহস্যময় অংশের অলিগলি নিজেই খুজে নিতে পেরেছেন , যা সত্যি বিস্ময়কর) ।

এরপর থেকে তিনি টিউশনি করে, পুরনো বই বিক্রি করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন।এভাবে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি ক্লাশে ভর্তি হন।এরমধ্যে তার বাবার ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে।তাই অনার্স তার হলো না।পাশ কোর্সে ভর্তি হন।

পুরাতন প্যান্টের ব্যবসা করে নিজের ও বাবার চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতেন। পরীক্ষার সামনে ভালভাবে পড়ার জন্য ছোট ভাইকে ঐ পুরনো প্যান্ট বিক্রির ব্যবসা চালিয়ে নিতে রাজি করান।
কিন্তু পরীক্ষার সময় ভাই বলে সে এই নিন্মমানের কাজ করতে পারবে না।

রোগীর ভাষায় -স্যার তখন আমার মাথায় হাত।আমি দিশেহারা হয়ে যাই।

বাবার চিকিৎসা খরচ,আমার পরীক্ষা - আমি কি করবো? আমি পুরো অসুস্থ পড়ি।

বুকে ব্যথা,মাথা ব্যথা,,অস্হির লাগে, সারা শরীর ঝিমঝিম করে,,শরীরে ধাক্কা মারে,ভয় লাগে,কাজ করতে পারি না,অশান্তি  - মনে হয় মারা যাবো।

চিকিৎসা করাই। অনেক টেস্ট করা হয়,সবই নরমাল। এভাবে ৬ মাস বাড়িতে বসে থাকি,অথর্ব হয়ে।

একদিন বাইরে গেলে একলোক আমাকে দেখে বলে - কিরে বাচবি নাতো,শরীর তো খুব খারাপ দেখাচ্ছে।

এতে আমি আরো ভড়কে যাই। বাড়ি থেকে আর বের হওয়ার মতন অবস্থা ছিল না।খুবই খারাপ সময় ছিল সেটি।

মাথায় চাপ দিয়ে রাখতো, মনে হতো চারপাশে ব্যান্ডেজ বেধে চাপ দিচ্ছে, কাজের প্রতি কোন আগ্রহ নেই, মনে হতো ঘুমের ঘোরে মরে গেলে ভাল।

এভাবে অনেক দিন চলে যায়। তখন মনে হলো কই মারা তো যাচ্ছি না।এরকম ভাবার পর মনে করলাম কাজ করে দেখি না।

ঢাকায় এসে আবার সেই পুরনো প্যান্ট বিক্রির কাজ শুরু করি। কাজ করি বটে কিন্তু শরীরের যন্ত্রণা যায় না।আবার ও সিটি স্ক্যান, ইইজি এসব করাই। কিন্তু সব পরীক্ষা নরমাল। রোগের তীব্রতা কখনো কমে কখনো বাড়ে।
তখন ১৯৯৪ সাল- স্যার তখন থেকে এই রোগ বয়ে বেড়াচ্ছি( তার মানে ২৪ বছর) ।

। কিছু দিন আগে ইউটিউবে আপনার কিছু ভিডিও দেখি ও জানতে পারি কিছু বইয়ের নাম,বিশেষ করে " মন ও মানুষ " বইটির কথা।

আমি আপনার বই পেতে অনেক জায়গায় খোঁজ করি, পাই না।সুদূর চিটাগাং থেকে এসে অনেক চেষ্টা করি।
পরে আজিজ সুপার মার্কেট এ খুজে পাই।১ মাস লাগে আপনার বই খুজে পেতে।

(বই পড়ার ২০দিন পর ওনি আমার চেম্বারে আছেন।এই ২০ দিনের মধ্যেই উনি বইটি পড়ে কি উপকার পেয়েছেন ও কিভাবে মনোজগতে পরিবর্তন আসলো তার বিবরণ জানতে
আমার " সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল -২৮" দয়া করে পড়ে নিন।তানাহলে পুরো বিষয়টি হ্রদয়ঙ্গম হবে না)।

উনার মানসিক দিক থেকে অনেক উন্নতি হলেও শারীরিক সমস্যা রয়ে যায়,যেগুলো হলোঃ

ক্লান্তি, মাংসে ঝিমঝিম করা,মনে হয় মাংসে চাপ দিয়ে রাখছে, পুরো শরীর ভার ভার লাগছে, মাথায় চাপ,হাতে চাপ ইত্যাদি।

২য় সেশনে এসে উনি নিজের আরো কিছু উন্নতির কথা যা বললেনঃ

১।হীনমন্যতা কেটে গেছে ঃ স্যার এটি কেটেছে সান্ত্বনায় নয়,যুক্তি দিয়েই। আমার থেকে জ্ঞান, সৌন্দর্য্য, অর্থ যাদের বেশি এগুলো তাদের চেয়ে ও বেশি থাকতে পারে অন্যদের। এজন্য তারা যদি হীনমন্যতায় না ভুগেন,আমি কেন ভুগবো?তা ছাড়া ডিপ্রেশন এ নিজের যোগ্য দিকের চেয়ে অক্ষমতার দিক বেশি নজরে পড়ে। আমার ডিপ্রেশন কেটে গেলে হীনমন্য লাগবে না

২। বিরক্তিবোধ কেটে গেছে ঃ আগে বিরক্ত লাগতো কারো সহানুভূতি না পেলে, কেউ খুশি না হলে, কারো সহায়তা না পেলে। এখন বুঝি ঘন্টার পর ঘন্টা অন্যের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা বোকামি, কাউকে গিফট দিয়ে তুষ্ট করার চেষ্টা অপ্রয়োজনীয় এবং অন্যের সহযোগিতার ভরসায় বসে থাকা মানে পরনির্ভরশীল থাকা।

৩। আমার ও গুন আছে, যোগ্যতা আছে - আমি নিজের গুনাবলীর একটি লিস্ট করেছি।

এতো দিন আমার মন শর্তাধীন ছিল বলে নিজকে নিয়ে নেতিবাচক বিশ্বাস ছিল। আমি ভেবে দেখলাম

ক) আমি সাহসী -আমি এতো কষ্টকর সময় পার করতে পেরেছি, আমি অনেক মানুষের সামনে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারি

খ) আমি সৎ- ফাইলে আমার সততার গল্প গুলো লিখে রেখেছি

গ) আমি সুস্থ - আমি তো মরে যেতে বসেছিলাম। এখন অনেক ভাল আছি - আলহামদুলিল্লাহ

ঘ)আমি সহনশীল - এতো দীর্ঘ কষ্টকর সময় পার করেছি

ঙ) আমি স্বচ্ছল-
আমার চাহিদা তো পূরন হচ্ছে। ছেলে মেয়ের চাহিদা মেটাতে তো পারছি

( যারা এ লেখা  পড়ছেন দয়া করে তার দারিদ্র্যতা স্মরন করুন। তিনি যদি নিজকে স্বচ্ছল ভাবতে পারেন,আপনি কেন নন?)

এই কেইস হিস্ট্রি থেকে যা শিখলাম

১। পুরনো প্যান্ট বিক্রি করে, ফুটপাতের হকার -এদের মধ্যে ও কামালউদ্দীনের মতন ট্যালেন্ট থাকতে পারে, আমরা কি তেমনটি জানি, মানি?

২। চরম দারিদ্র্যতা না থাকলে, প্রতিকুলতা না থাকলে কামালউদ্দীনরা পিএইচডি করে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, গবেষক হতে পারতেন -সে সুযোগ কি রাস্ট্র, সমাজ তাদের জন্য সৃষ্টি করবেন?

৩। মানসিক চাপ,জীবন জটিলতা মন- ব্রেইনকে কেমন বিপর্যস্ত করে এ কেইস থেকে তা অনুমেয়

৪।  অনেক দামী টেস্ট করেও সব নরমাল মানে সে রোগী নয়,বানিয়ে বলছে বা ভান করছে তা নয়।

৫। মানসিক রোগের অন্যতম লক্ষণ হতে পারে শারীরিক লক্ষণ। সেগুলো হতে পারে তীব্র ও দীর্ঘস্হায়ী

৬। ভাল  ও বিজ্ঞানসম্মত  বই জীবন বদলে দিতে পারে, মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে।ভাল বই পড়ুন,ভাল বই লিখুন(এতে  নিজের আত্মপ্রচার মনে হলেও কিছু করার নেই।বরং আমি গর্বিত যে আমার বই পড়ে কিছু লোক উপকার পাচ্ছেন ) ।

No comments:

Post a Comment