বিবেকের কাঠ গড়ায়
(এবিসি রেডিও এর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান (জেবিএসবি)-যাহা বলিব সত্য বলিব এর নিয়মিত পরামর্শদাতা হিসেবে অভিজ্ঞতার কিছু অংশ আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে এই বিভাগ)
ঘটনা সংক্ষেপ:
আবেদ(ছদ্ম নাম) বয়স বর্তমানে ২৫।
মোটামোটি স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান।ইন্টারমিডিয়েট পাশ।
সে প্রায়ই ব্রীজের উপর ঘুরে বেড়াতো।
একদিন সেখানে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় যে ছিনতাই দলের সদস্য ছিল।
আলাপের পর আবেদ অনুপ্রানিত বোধ করেন।
সে ভাবতে থাকে এদের সঙ্গে থাকলে সবাই ভয় পাবে,সবাই তাকে খাতির ও সমাদর করবে।
সে নিজেকে এ ভাবে "হিরো" হিসেবে কল্পনা করতে লাগলো।
ঐ বড় ভাই তাকে টেলিফোনে পাবনার সর্বহারা দলের এক বিগ বসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়।
বস তাকে লোভ দেখায় তোমাকে দূরুত বড় লোক বানিয়ে দেবো,তোমার অনেক উন্নতি হবে।তবে আমাদের কথামত কাজ করতে হবে।
আবেদ বললো,বস যা বলবেন সব করবো।
এর মধ্যে আবেদের এক বন্ধু তাকে প্রস্তাব দেয় তার সঙ্গে ঢাকা যেতে,কেননা সে বিদেশ যাবে সে কারনে তাকে টাকা জমা দিতে ঢাকা যেতে হবে।
সে এ কথা তার ঐ সন্ত্রাসী বন্ধুকে বলে।
ঐ বন্ধু ও তাদের লিডার তাকে বলে সে যেন ঐ ছেলের সঙ্গে যায় এবং তার কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে লন্চ থেকে রাতের অন্ধকারে থাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়( চাদপুরের লন্চে ঢাকা আসার কথা)।
সে এ কথায় রাজী হয়।
লন্চে এসে আবেদ দেখে সন্ত্রাসী বন্ধু আরো একজনকে সঙ্গে নিয়ে লন্চে উঠেছে।
সে ঐ ছেলেকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে অচেতন করে ফেলে ও তার টাকা হাতিয়ে নেয়।
আবেদ পরে ভাবে টাকা তো নিয়ে ফেলেছি তাই মারার কি দরকার।সে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে ঐ সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেয়।তারা তাকে ১০ হাজার টাকা দেয়।
এতেই সে মহা খুশী।
জীবনে এক সঙ্গে এত টাকা সে কখনো কামাই করতে পারেনি।
পরে সে কিছুটা অনুতপ্ত হয়ে সেই বন্ধুকে বলে দেয় যে তারা তার টাকা নিয়েছে এবং এটি সে তাকে ফেরত দেবে।
আবেদনকারী তার মাকে বলে কাজ পাওয়ার জন্য টাকা ধার নিয়েছিল,সে গুলো খোয়া গেছে।এখন মা যেন ধার করে হলেও সে টাকা তাকে দেয়।
মা সুদে টাকা ধার নিয়ে তাকে দেয়।
পরে ঐ বন্ধু তার মা ও অন্যান্যদের বলে দেয় যে সে তার টাকা ছিনতাই করে নিয়েছে।তাই সে বাধ্য হয়ে ঘর ছাড়ে।
সন্ত্রাসী বন্ধুরা তাকে আশ্রয় দেয় ও সাহস যোগায় যে এটি ছিল তার প্রথম কাজ তাই ঝামেলা হয়েছে।
পরবর্তীতে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওরা তাকে গ্রীনলাইফ বাসের কাউন্টারে চাকরী জোগাড় করে দেয়।
তাদের পরামর্শে এক সময় সে সেখান থেকে ২ লাখ টাকা চুরি করে পালিয়ে আসে।
সে টাকাও সে ওদের হাতে তুলে দেয়।তাকে ২০-৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
এ ভাবে সে ৩-৪ টা সফল মিশন করে।
এর মধ্যে সে বিয়ে করে এবং এক সন্তান ও হয়।
ঐ চক্র এবার তাকে শ্বশুড় বাড়ীর লোকদের সরকারী চাকরী দেবার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বুদ্ধি দেয়।
সে তাই করে এবং ৮০ হাজারের মতন টাকা বাগিয়ে আনে।কথা ছিল ২-৩ মাসের মধ্যে চাকরী দেবে।
চাকরী দিতে না পারাতে সে চাপের মুখে পড়ে।
তখন সে তার সন্ত্রাসী বন্ধুদের বলে তোমরা আমাকে বড় লোক বানিয়ে দেবে বলেছিলে,অনেক উন্নতি হবে বলেছিলে, তোমরা কথা পূরন করো।
তখন তারা তাকে পাল্টা হুমকি দেয় যে তুমি অনেক অপরাধ করেছো,বেশী বাড়াবাড়ি করলে তোমাকে ফাসিয়ে দেবো।
তখন সে তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে ও নিজের মোবাইলের সীম বদলে ফেলে।
এর পর ও তার বড় সন্ত্রাসী হওয়া, ক্ষমতাবান হওয়ার বাসনা রয়ে যায়।
সে ইন্টারনেটে একটি গ্রপের সঙ্গে পরিচিত হয়।
তারা নিজেদেরকে জঙ্গি আই এস বলে দাবী করে।
সে ভাবে এবার সে আরো বড় ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে।কিন্তু ঐ চক্র তার কাছ থেকে হাদিয়া হিসেবে টাকা চায় এবং অন্যান্য কার্যকলাপে তার কাছে মনে হলো যে এটি ভুয়া গ্রপ।
এর পর সে র্যাব এর কাছে যায় ও তার জীবনের সব কথা বলে দেয়ও সে ভালো হওয়ার সুযোগ চায়।।
র্যাব এর লোকেরা তার মোবাইল ঘাটাঘাটি করে বলে ঐ গ্রপ ভুয়া এবং তাকে ভালো হয়ে যাওয়ার কথা বলে ছেড়ে দেয়।
এখন সে সত্যি ভালো হতে চায়।সে তার বউ এর সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করেছে।
আমরা আবেদের অপরাধ জগত থেকে স্বাভাবিক জগতে ফিরে আসাকে স্বাগত জানাচ্ছি ও তার পরিবারের জন্য দোয়া করছি
আমার কিছু পর্যবেক্ষন:
১।কৈশোর বয়সে এডভান্চিরিজম,হিরো ইজম একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।
কেউ হিরো হতে চায় বড় বিজ্ঞানী হয়ে,বিখ্যাত লেখক,গায়ক,নায়ক বা খেলোয়ার,রাজনীতিবিদ হয়ে।
আবার আবেদের মতন কিছু তরুন হিরো হতে চায় কুখ্যাত সন্ত্রাসী হয়ে।
কেন আবেদদের রোল মডেল এমন হয়?
আবেদ অনুপ্রানিত বোধ করলো ক্ষমতা পেয়ে অন্যকে ভয় দেখাতে পারবে বলে।
ভয় দেখিয়ে সমাদর,সম্মান, অন্যের সালাম পাওয়ার এই রোল মডেল তারা কি আমাদের সমাজ থেকেই পাচ্ছে না?
আমাদের সমাজে শিক্ষিত,মেধাবী,জ্ঞানী,সৎ, উচ্চ নৈতিকতার মানুষরা কি সবার কাছ থেকে,রাস্ট্র, সমাজ থেকে যথাযথ সম্মান,গুরুত্ব ও মর্যাদা পাচ্ছে?
পদ পদবী,ক্ষমতা,অর্থ,প্রতিপত্তি কি তাদের দখলে না, নাকি তা বিবেক বর্জিত,অসৎ,পা চাটা,চামচা জাতীয় মাস্তান গ্রপের হাতে জিম্মি?
বর্তমান প্রজন্ম নৈতিক উন্নতির চেয়ে বৈষয়িক উন্নতির কথা আগে ভাবে।
সমাজ,রাজনীতি,প্রশাসন,ব্যবসায় কারা উন্নতি করছে?
কারা সামনের কাতারে আছে?
রোল মডেল তারা হবে নাকি অসম্মানিত,উপেক্ষিত,পিছিয়ে থাকা নীতি বাগিশরা হবে?
২।পাবনার সর্বহারা দলের নেতা(?) চাদপুরের প্রতারক চক্রকে নিয়ন্ত্রন করে।
আদর্শবাদের চর্চা করতে গিয়ে, বিপ্লবী পথ ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে প্রায় বেশীর ভাগ আদর্শবাদী দল বা তার অনুসারীরা কেন সন্ত্রাসী পথ বেছে নেয়?
এটি কি সমাজ আদর্শকে গ্রহন না করাতে হতাশা, ব্যর্থতার ফলশ্রতি?
এটি কি বিপ্লবী ক্রিয়া কান্ডের সঙ্গে অনুসঙ্গ হিসেবে প্রাথমিক ভাবে উগ্র পন্থাকে,কিছুটা সন্ত্রাসকে বেছে নেওয়ার পরবর্তী ফলাফল?
বিপ্লবীদের এ দিকটি ভেবে দেখতে হবে।
৩।প্রতারক চক্র যে কত সঙ্গবদ্ধ ও বিচিত্র পন্থায় প্রতারনা,জালিয়াতি করে থাকে এটি তার প্রমান।
বন্ধু থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়া,পূর্ব পরিকল্পনা মত নামকরা বাসের কাউন্টারে চাকরীর নামে টাকা লুট,চাকরী দেবার প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে সর্বসান্ত করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়া- কি না?
এই জালিয়াতি চক্র ঠান্ডা মাথায়, প্রচুর বুদ্ধি খাটিয়ে অভিনব পদ্ধতি আবিস্কার করে মানুষকে প্রতারনার ফাদে ফেলে।
সাধারন মানুষের পক্ষে এমন প্রতারনা ধরা কঠিন।
তাই রাস্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এবং সংবাদ মাধ্যমকে এ বিষয়ে অগ্রনী ভূমিকা নিতে হবে।
যাতে সাধারন মানুষ এ রকম প্রতারনা ফাদে না পরতে পারে।
৪। বিভৎস্য ব্যাপার হচ্ছে সামান্য কিছু টাকার জন্য এত দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে লন্চ থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে ও তার বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ কাজ করেনি।
পত্র পত্রিকায় প্রায়ই আমরা দেখি বন্ধুর মোবাইল ফোনটি নেওয়ার জন্য বা তেমন দামী কিছু(তাদের কাছে কয়েক হাজার টাকার জিনিসই মহা মূল্যবান) জিনিসের লোভে কিছু কিশোর একত্র হয়ে ঐ ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নির্মম ভাবে হত্যা করে।
লোভ মানুষকে অমানুষ বানায়।
আমরা কি শিক্ষা নিচ্ছি,পাচ্ছি বা দিচ্ছি শিশুদেরকে?
নিজ পরিবারে,আপন সমাজে কিসের হাতছানী আমাদেরকে বেশী টানে?
কোথায় সে উদাহরন যে লোভ,লালসা,কামনা নয় সৎ,সুন্দর,নৈতিক জীবনই অধিক কাম্য?
৫। আবেদ প্রতিবারই নিজে টাকা চুরি করে বা প্রতারনা করে ঐ চক্রের হাতে দিয়ে দেয়।
সে তো ইচ্ছে করলে নিজের অসৎ উপার্জন নিজের কাছে রাখতে পারতো।
সে কেন তাদের ক্রীতদাস হতে গেলো?।
কারন এ রকম অসৎ,বে-আইনী পথে যারা হাটে তারা শক্তি,ভরসা পায় কোন গড ফাদার বা রাজনৈতিক শক্তি থেকে।
তারা নিজেরা হচ্ছে খুবই ভীতু ও দুর্বল।
পিছনের খুটির বলে তারা ক্ষমতার দম্ভ দেখায়।
ঐ মদদ দাতাদের বিরুদ্ধাচারন করে তারা শুধু টিকে থাকতে পারবে না তা নয়,তাদের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যেতে পারে।
আবেদও তার প্রমান।
৬।আই এস সহ মুসলিম জঙ্গী গোষ্ঠীতে কেবল মাত্র আদর্শের কারনে,ধর্মীয় কারনেই যে সব তরুন যায়,তা নয়।
আবেদের মতন কিছু তরুন ক্ষমতা পাওয়া ও বড় সন্ত্রসী হওয়ার জন্যও এতে যোগ দিতে পারে।
৬।ইন্টারনেটে বিভিন্ন প্রতারক চক্র রয়েছে তা আমরা জানি।
কিন্তু আই এস বা ইসলামী জঙ্গি নামে ভুয়া গ্রপও তৈরী হচ্ছে এটি নতুন জানা।
ভেজাল সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে
এটি ভয়াবহ সংবাদ
No comments:
Post a Comment