Thursday, November 3, 2016

সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল- ৬

নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতে যাচ্ছি স্যার

এটি ছিল কাউন্সিলিং থাকা নিজকে বদলে ফেলা এক সফল রোগিনীর আত্ম-তৃপ্ত ও আত্ম বিশ্বাসী  গর্বিত উক্তি

অনেকেই হয়ত জানেন, আমাদের সিংহভাগ রুগীকে শুধু ঔষধ চিকিৎসা দিয়ে পূর্ন আরোগ্য লাভ সম্ভব না।
আর রোগকে মূল থেকে উৎপাটিত করতে  হলে রুগীর চিন্তা,মনন,দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হয়।

এর জন্য সাইকোথেরাপি বা কাউন্সিলিং এর বিকল্প নেই।
কাউন্সিলিং ও সাইকোথেরাপির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে(এখানে সেটি বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই)।
আবার সাইকোথেরাপিরও রয়েছে নানা ভাগ,নানা প্রকারেরর।

এর মধ্যে সিবিটি(কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি) হচ্ছে সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সব চেয়ে কার্যকর সাইকোথেরাপি,বিশেষ করে ডিপ্রেশন চিকিৎসায়।

আমি সিবিটির একনিষ্ঠ ভক্ত।

 মূলত সংক্ষিপ্ত, ঘনবদ্ধ ও লাগসই( brief, condensed,case and context appropriate)  সিবিটি আমি রোগী চিকিৎসায় প্রয়োগ করে থাকি।
(চেম্বারে লম্বা সময় নিয়ে সাইকোএনালাইসিস পদ্ধতি ব্যবহার বাস্তব সম্মত নয়)

রোগ কাহিনী:রোগ কাহিনী নামে আমাদের একটি স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে।এখানে রোগকাহিনী গুরুত্বপূর্ন নয়।

কিভাবে থেরাপি রুগীকে বদলে ফেলে তার দৃষ্টান্ত দেখানোর জন্য এই ডায়রী লেখা।
বেশ কিছু সমস্যা নিয়ে তিনি আমার চেম্বারে আসেন।ইতিহাস নিয়ে যা জানা গেলো:

রোগীনি একটি কলেজের সহকারি  অধ্যাপক।
তার ভাষায়,স্যার আমি ও আমার পরিবার সফট মাইন্ডেড,উচ্চ শিক্ষিত।
বাবা ছিলেন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল, অন্যান্য আত্মীয়রাও উচ্চ পদস্হ ও উচ্চ শিক্ষিত।
আমরা বই পড়া,সাংস্কৃতিক চর্চায় বেশী আগ্রহী।অন্যদিকে স্বামী ব্যবসায়ী, তবে তিনি আমার অবস্হা বুঝেন।
কিন্তু আমার শ্বশুড় বাড়ীর প্রায় সবাই রূড,হার্ড ও বেপরোয়া।তারা আমাকে,আমার শিক্ষাকে ত কোন দাম দেয় না-ই,উপরোন্ত এ নিয়ে টিটকারী করে।
তার(স্বামীর) বোনেরা আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে,উপহাস করে,প্রায়ই আমার সঙ্গে বেয়াদবী করে। তারা এমন এমন কথা ও আচরন করে যে সারাক্ষন আমার মনে রক্ত ক্ষরন হতে থাকে়।
আমি যন্ত্রনায় বিদ্ধ হই।স্বামীকে বললে তারা সব এক জোট হয়ে তা অস্বীকার করে ওআমাকেই অপরাধী,দোষী সাবস্ত্য করে।
আমি এদের সঙ্গে পেরে উঠছি না স্যার।
সামাজিক ও পারিবারিক চাপের কারনে সংসারও ত্যাগ করতে পারছি না।তবে স্বামী সব সময় সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু আমার মন-যন্ত্রনা কমছে না।

তিনি বলেন টেনশনে আমার ঘুম হয় না,নিজকে ছোট মনে হয়।মনে হয় আমি হয়ত শিক্ষিত কিন্তু বুদ্ধি,দক্ষতা,ব্যক্তিত্বে  আমি ঐ অল্প শিক্ষিত মেয়ে গুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
তারা সুখী,সাহসী ও সবার প্রিয়।
অথচ আমি সঙ্কোচিত,বিব্রত,অসুখী ও সবার কাছে অপ্রিয়।এমনকি আমার মা বাবার কাছেও।
তারাও বলে তোমার ঘাটতি আছে,সমস্যা আছে তা না হলে এমন হবে কেন?

স্যার ঐ সব বিদূপাত্মক কথা ও আচরন আমি ভুলতে পারি না।সারাক্ষন অস্হির থাকি,ভয়ে থাকি

টেনশন আসলেই বুক চেপে আসে,মন চুপসে যায়।

ঔষধ সহ সাইকোথেরাপির ডেট দিয়ে দিলাম।
৪-৫টি থেরাপিতেই তিনি আরোগ্য লাভ করলেন।

গতকাল এসে তিনি তার ঐ প্রত্যয় দীপ্ত উচ্চারন করলেন।

চিকিৎসকের প্রধান গর্ব,শ্রেষ্ঠ  পুরস্কার ও তৃপ্তি রোগীকে রোগ থেকে পূর্ন মুক্তি দিতে পারা।
একমাত্র সাইকেথেরাপি যদি সফল হয়, তখনই মাত্র এমন কৃতিত্ব একজন সাইকিয়াট্রিস্ট পেতে পারেন।।

বিনীতভাবে হলেও যথেষ্ট তৃপ্তির সঙ্গে বলতে পারি এমন গর্ব, তৃপ্তি আমি অনেকবারই পেয়েছি।

তারই একটি উদাহরন আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।

আমি বললাম,কিভাবে জিতে যাচে্ছন?।উদাহরন দিন।
তিনি বললেন গত সপ্তাহে এক পারিবারিক ইনফর্মাল মিটিং এ আমি কায়দা করে,সবার সামনে আমাকে নিয়ে চরম অপমানজনক কথার প্রসঙ্গটি উঠাই (অনেক অপমানের একটি) ও বলি, যদি অন্য কেউ  তেমন কথা বলতো আমি সরাসরি তাকে জোরসে চড় মেরে দিতাম।
ঐ মেয়েও সেখানে ছিল। লক্ষ্য  করলাম সে বিব্রত ও সংকুচিত হয়ে চুপসেে গেল(মুরুববীরাও ছিল)।এক পর্যায়ে তারা আমার কাছে দুংখ প্রকাশও করে।

এই প্রথম বার তিনি এসারটিভ (  assertive)আচরন করতে পেরেছেন, ফলে তার ক্ষোভ,যন্ত্রনার উপশম হয়।
আমরা মূলত নিজেদের অধিকার আদায়ে,মতামত প্রকাশে  ৩ ভাবে প্রতিক্রিয়া করে থাকি।

১।আক্রমনাত্মক ভাবে(aggressive) - নিজের মত ও ইচ্ছা জানাতে, নিজের সুযোগ ও অধিকার আদায়ে কেউ কেউ  আক্রমনাত্মক আচরন করে  থাকে।
২। আত্ম সমর্পনমূলক( submissive) :
কেউ কেউ উল্টো রকমের।তারা নিজের মত অভিমত প্রকাশে বা নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ও আত্ম সমর্পনমূলক আচরন করে থাকেন।
তারা নিজকে গুটিয়ে রাখেন,সংকুচিত থাকেন,লাজুক-ভীতু প্রকৃতির হন।ফলে অন্যরা তাদেরকে মাড়িয়ে যায়,তুচ্ছ করে,অপদস্ত করে বাতিলের খাতায় ফেলে রাখে।(যেমন আমাদের আজকের রুগিনী)।

৩।দৃড়, তবে ভদ্র ভাবে নিজের মত প্রকাশ( assertive) :
এটি হচ্ছে উত্তম পদ্ধতি,ঐ দু'এর মাঝখানের অবস্হান।
এখানে ব্যক্তি সাহস ও দৃড়তার সহিত অথচ মার্জিত,ভদ্র ভাবে নিজের মত তুলে ধরেন ও অধিকার আদায় করে নেন।অন্যকে অসম্মান না করেও নিজের স্বাধীন মত প্রকাশে তারা কুন্ঠাহীন

আমাদের রুগিনী জীবনে এই প্রথম বারের মতন নিজের অভিযোগ,ক্ষোভ এমনকি ক্রোধ ও বাদানুবাদ না করে,ঝগড়া ফ্যাসাদ না বাধিয়ে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন।এতে তার ক্ষোভ,যন্ত্রনার লাঘব ঘটে।তিনি আত্ম বিশ্বাস ও আত্ম সম্মান বোধ ফিরে পান।তার মন অটোমেটিক প্রশান্তি লাভ করে,তিনি ভিতর থেকে রিলিফ ফিল করেন।

২য় উদাহরন জানতে চাইলে তিনি বললেন,গতকাল তার বস(প্রিন্সিপ্যাল) ) সভায় থাকায় তিনি  আগে আগে বাসায়  চলে আসেন।
বাসায় আসার পর  তার ভয় করতে লাগলো তাকে না দেখে বস রেগে যেতে পারেন।

তিনি বলেন তখন আমি নিজকে বললাম যদি তেমন হয় ও আমাকে জিজ্ঞেস  করেন, তাহলে বলবো শরীর খারাপ হওয়াতে চলে আছি।
এমনটি মনকে বলার  সঙ্গে সঙ্গে  উনার মনের ভীতি,অস্হিরতা, টেনশন নিমিষে চলে যায়।

আমি ব্যাখ্যা করি যে বেশীর ভাগ উদ্বেগ-টেনশনের কারন হচ্ছে  মনের ভিতর জানা/অজানা আশঙ্কা,হুমকির বোধ কাজ করা।উনার বস নাখোচ হলে,বিরক্ত বা  ক্রোধান্বিত হলে  উনার উপর হয়রানি হবে এই আশঙ্কাই উনার উদ্বেগের মূল কারন ছিল।
যেই মাত্র তিনি তার মনকে  এই বলে আশ্বস্ত করতে পারলেন যে উনার অসুস্হতার কথা শুনলে তিনি আর রাগ করে থাকবেন না, তখনই উনার মন থেকে দুঃশ্চিন্তার পাথর নেমে গেল।
তিনি রিলিফ ফিল করলেন।

চিন্তা>অনুভূতি/আবেগ>আচরন

উপরের চার্টটি লক্ষ করুন:
আমাদের চিন্তা আমাদের আবেগ/অনুভূতির উপর প্রভাব ফেলে;
আবার অনুভূতি আমাদের সার্বিক আচরনকে প্রভাবিত করে।
আর আচরন নির্ধারন করে আমরা সুখী হবো না অসুখী হবো;সফল হবো না অসফল হবো;সম্পর্ক ভালো থাকবে না মন্দ হবে।

তাই  নেতিবাচক,অকার্যকর,অশুভ  অসুস্হ চিন্তাকে বদলে ফেলে যদি বিকল্প ইতিবাচক, কার্যকর,কল্যানমূলক মূলক সুস্হ চিন্তা মনকে দিতে পারি তাহলেই জীবন বদলে যাবে
যেমমটি ঘটেছে আমাদের রুগিনীর ক্ষেত্রে।

সাইকোথেরাপির মূল লক্ষ্য হচ্ছে রুগী যাতে নিজ সক্ষমতায় নিজকে ভালো রাখতে পারে সে রকম দক্ষ করে তাকে গড়ে তোলা।
তিনি এখন থেকে তেমনটি পারবেন বুঝতে পেরে আমার মন গর্বে ও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো।

No comments:

Post a Comment