Wednesday, December 28, 2016

রোগ কাহিনী: ১০

" ভয়ে আমার কইলজা-গুরদা গইল্লা যায়"

আপনাদের মনে থাকার কথা " সাইকিয়াট্রস্ট এর জার্নাল -৫ এ আমি সন্তান প্রতিপালনের ৪টি ধরন নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।
এ ৪ ধরনের একটি হচ্ছে সন্তানকে" বশ্যতা স্বীকারে বাধ্যকরন" প্রতিপালন পদ্ধতি(Authoritarian type)।
আজ সে ধরনের এক বাবার কাহিনী আপনাদের জানাবো--

কাহিনী সংক্ষেপ :

মো. আলম বর্তমানে বয়স ৩০, বিয়ে করেননি( মূলত বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছেন - কেন সে রহস্য শীঘ্রই উদঘাটিত হবে)।

তারা ৫ ভাই , তিনি ৪র্থ।তার বাবা হলুদ- মরিচ ভাঙ্গার কাজ করেন।

যে সমস্যাদি নিয়ে আমার কাছে আসেন :

ভয়-ভীতি,টেনশন,দুশ্চিন্তা,ভুলে যাওয়া, অস্হিরতা,মাথা উথালপাতাল লাগা,মাথায় গরম জ্বালা পোড়া,চিন্তায় চুল পেকে গেছে,বুকে এসে ভয় ভীতি লাগে,পেট চিবায়,ঘুর ঘুর করে ইত্যাদি।

একটু সময় নিয়ে আলাপ করাতে যা জানা গেলো:

ছোটকাল থেকেই বাবা কড়া শাসনে রাখতো।পান থেকে চুন খসলেই অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চলতো।

যা করতে বলবে একটু দেরী হলেই হাতের কাছে যা থাকতো তা দিয়ে আঘাত করতো।
স্ক্রু,হ্যান্ডেল দিয়ে মাথায় আঘাত করতো।

ঘরে জায়গা দিতো না।
আমরা ভয়ে বাইরে বাইরে থাকতাম।উনি কাচি নিয়ে খুজতে বের হতেন।যেখানে পেতেন সেখানেই  এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করতেন।

একদিন মারের ভয়ে দৌড় দেই।এক ফাকে
এক পুকুরে ঝাপ দেই।
একটি গাছের গোড়া ধরে  পানিতে ডুব দিয়ে থাকি।

নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তবু উঠি না,  যদি বাবা দেখে ফেলে।
এক সময় আর টিকতে না পেরে উঠে যাই।

উঠেই ভূত দেখার মতন আটকে উঠি।
দেখি বাবা কাচি হাতে  একেবারে আমার সামনেই দাড়িয়ে।

উনিশ- বিশ হলেই লাঠি নিয়ে মারতে আসতো।আমি দৌড়াতাম,দৌড়ে কুলাতে পারতাম না।হোচট খেয়ে পরে যেতাম,সেখানেই মারের উপর মার।

অনেক সময় ভয়ে সারাদিন বাইরে থাকতাম। 
রাতে চুপিচুপি ঘরে ঢুকতাম। 

রুমে ঢুকে সারারাত ঘুম আসতো না, কখন বাবা এসে ধরে ফেলে।
জানালা আটকানো যেতো না,তাই ভয় হতো কখন জানি জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ধরে ফেলে।

সব ভাইকেই মারতো,তবে আমাকে বেশী মারতো।
অন্য ভাইরা দূরে দূরে থাকতো।
একদিন  রন্ডি কড়ই গাছের ডাল কেটে ফেলায় বাবা বড় ভাইকে কোপাতে গেলে বড় ভাই রুখে দাড়ায় ও তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়।

মাকেও মারতো।

একদিন স্কুলে যাইনি বলে আমাকে ও ছোট ভাইকে শেকল দিয়ে পা বাধে।
মসজিদের ভিতর তালা দিয়ে আটকে রাখে।
তালা ও শেকল নিয়ে হাটতে হাটতে পা ফুলে যায়। 

এ অবস্হায়ই আমাদেরকে স্কুলে নেওয়া হয়।

স্কুলের ম্যাডামরা বাবাকে বলেন আপনি কাজটি ভালো করেননি।
তখন মনে হয়েছিল এত অত্যাচার, এ জীবন রাখবো না

ধান ক্ষেতে নিড়ি দিতে গিয়ে একটু দুষ্টামি করলে মারতো  ও বাড়ীতে খাবার বন্ধ করে দিতো।

মা পরের বাড়ী থেকে এনে খাওয়াতো।তার জন্য মাকেও মারতো।

দোকানে ছোট ভাই বসতো। হিসেবের গরমিল হওয়াতে বাবা তাকে মারে।
ছোট ভাই রাগ করে বলে দোকানে বসবে না।আমাকে বসতে বলে।

বাবা বলে "খানকির পোলা" দোকানে গেলে কল্লা ফেলে দিবো( গালি শুনে আমাকে কেউ গালি দিতে আসবেন না- লেখার অযোগ্য অনেক গালি আছে,স্যাম্পল হিসেবে দুএকটি বলবো মাত্র)। 

ভয়ে কলিজা- মলিজা গলে যেতো।

এ ভাবে ১৫-১৬ বছর অত্যাচার চলে।
আমি ও ছোট ভাই অতিষ্ঠ হয়ে ঠিক করি পালিয়ে ঢাকা চলে যাবো।

মাকে বলি দোকানে মাল কিনতে যাবো( কচুয়ায়)। 

ছোট ভাই বলে পান্জাবী ইস্ত্রি করতে যাবো। 

এ ভাবে দু'ভাই সবাইকে ফাকি দিয়ে ঢাকা রওয়ানা হই।

( ছোট ভাই আগে কয়েকবার ঢাকা গেছে)। 

এক সাইকেলেই দুজনে যাচ্ছি।গৌরী পুর ব্রীজে   আসার পর আমাদের আটকে দেয়,সাইকেল নেওয়া মানা।তখন সাইকেল বাসের ছাদে উঠিয়ে ঢাকা রওয়ানা হই।

বড় ভাই চকবাজারে পচা সাবান কারখানায় কাজ করতো।সেখানে যাই। 

দুজনে ভাবতে থাকি মাকে না বলে এসেছি, মাতো কান্না কাটি করবে।

সন্ধায় ভাই আসলে সব বলি।ভাই মাকে ফোন করে সব জানায়।মা কান্নাকাটি করে,বাবাকে গালাগালি করে,ভাত খায় না।

৭ দিন পর বাবা আমাদের খোজে ঢাকা আসে।
 ভয়ে আমি রুমে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকি।

 বাবা এসেই বলে" চুদির পুতেরা "আমার এতো ভালো বাড়ী রেখে কোন জায়গায় এসে ঘুমাচ্ছে।

বাবা আমাদের নিতে চায়।আমরা রাজী  হই না।

আবার সেখান থেকে পালাই।
বাবা চলে  যাওয়ার পর আবার ফিরে আসি।

বড় ভাই বলে তোদের এখানে জায়গা নেই।বাবা বলে গেছে আমরা যেন আর বাইত না যাই।

তখন ভাবি বাবা তো জায়গা দেবে না,নিজেই কিছু করি।
একটি টং দোকানে চায়ের কাজে লাগি।

দেড় মাস পর বাড়ী যাই।বাবা খুব রাগ করে।এখন ও মাঝে মাঝে বাড়ী যাই।তবে বাবার থেকে দূরে দূরে থাকি।
উনাকে দেখলেই মনে হয় বাঘ দেখছি।

রাতে ঘুমের ভিতর দেখি বাবা অনেককে নিয়ে আমাকে মারতে আসছে, আমি মাঝ খান থেকে উড়ে যাচ্ছি

এখনো ভাত খাওয়ার সময় বাবাকে দেখলে থালা নিয়ে দৌড় মারি।

বিয়ে করতে ভয় পাই কারন বাবাকে দেখলে ওদের ( বউ,তার আত্বীয়) সামনে থেকেই দৌড় দিতে হবে,সেটি কেমন দেখাবে?

( প্রতিটি কথা হুবহু রোগী যে ভাবে বলেছে সে ভাবে লিখেছি।
এটি হয়তো এক অতি কড়া বাবার কাহিনী।
কিন্তু কম মাত্রার হলে ও এমন নিষ্ঠুর ও কড়া শাসন অনেক পরিবারেই রয়েছে)। 

No comments:

Post a Comment