Wednesday, April 5, 2017

রোগ কাহিনী -১৬

মেয়ে বলে " মেয়েদের উপর থেকে আদর,মায়া সব উঠে গেছে স্যার"
মা বলে" জীবনেও শহর দেখিনি,মেয়েকে নিয়ে একাই আপনার কাছে চলে এসেছি স্যার"
রোগ কাহিনী:
আয়শা বেগম,বয়স ২৪। দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। কোন ছেলে সন্তান নেই।
আশেপাশের সবাই বলে মেয়েদের বিয়ে হলে অন্য সংসারে চলে যাবে, তখন বৃদ্ধ অবস্হায় তোমাকে কে দেখবে?
এরপর একা একা ভাবতাম  ঠিকই তো শেষ বয়সে ছেলে না থাকলে কে দেখবে,কেমনে একাকী থাকবো?
মেয়েদের উপর থেকে আদর, মায়া সব উঠে যায়।সারাদিন ছেলের চিন্তা মাথায় ঘুরে।মাকে বলি আমাকে একটি পালক ছেলে হলেও এনে দাও।

বার বার একই চিন্তা।কিছু ভালো লাগে না।কেবল হাহুতাশ।ঘর সংসারের প্রতি মায়া নেই,কান্নাকাটি করি,ঘুম হয় না,কলিজা ধক ধক করে, কান গরম হয়ে যায়,মানুষের সহিত মিশতে ভালো লাগে না,কেবল চিন্তা কে শেষ বয়সে আমাকে দেখবে,আমার পাশে  থাকবে?
স্যার আমাকে আগের দিন ফিরিয়ে দিন।আমি মেয়েদের যেন আগের মতন মমতা করতে পারি।ঘরে এলেই মনে হয় আমি একা, মেয়েরা  চলে গেছে,আমি শেষ বয়সে,আমি বুড়ী  হয়ে গেছি।একা কেমনে থাকবো?

মা,স্বামী সবাই বোঝায়,কিন্তু আমার মন মানে না।রোগীনির মা বলে স্যার মেয়ের বেহাল অবস্হা দেখে আমাদের পাশের বাড়ীর একজন বললো আপনার কাছে এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।আপনি নাকি জ্বীন ভূত ও তাড়াতে পারেন।

স্যার জীবনে কোনদিন শহর দেখিনি।মা- মেয়ে সাহস করে আপনার ঠিকানা নিয়ে ঢাকা শহরে আইছি।আমার মেয়েকে বাচান।

মেয়ে বলে স্যার আমি চাই আমার আগের দিনগুলো ফিরে আসুক,মেয়েদের প্রতি, সংসারের  প্রতি আকর্ষন,মমতা ফিরে আসুক।ছেলে শব্দটা যেন আর মনে না আছে।
...........................
এই কেইস হিস্ট্রি থেকে আমরা কি শিক্ষতে পারি?
১।  নবীজীর আমলে নাকি কন্যা সন্তান হলে মেরে ফেলা হতো।সে অন্ধকার যুগ থেকে কতটুকু এগিয়েছি আমরা? এখনো গর্ভবতী মায়েরা আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে গেলে প্রথমেই জানতে চান " ছেলে না মেয়ে"? বাচ্চার অবস্হা কেমন সেটি আগে জানতে চান না।আমার জানা এক তরুনী একজন কন্যা সন্তান হওয়ার পর স্বামী - শ্বশুর বাড়ীর সবাই খুবই নাকোচ হয়।অজ্ঞতা বশত কয়েক মাসের মধ্যে আবার গর্ভবতী হয়ে যায়।এবার স্বামী স্ত্রী কাউকে না জানিয়ে ঠিক করে সন্তান এখন নষ্ট করবে না,আগে জানবে ছেলে না মেয়ে।যদি ছেলে হয় তাহলে নষ্ট করবে না।তারা বার বার আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে যায় জানতে ছেলে না মেয়ে।দূর্ভাগ্যবশত তাদের জানানো হয় এখনো স্পস্ট নয়,বলা  যাবে না।এ ভাবে ৪-৫ মাস হয়ে যায়,তবুও জানতে পারে না।তাই তারা আর কোন রিস্ক না নিয়ে অবৈধ ভাবে এবরশন করান। নারী- পুরুষ  সমতার যুগে ছেলে সন্তান এখনো এতো কাম্য কেন?
২। আমার আরেক রোগীনির শ্বাশুড়ী তাকে সারাক্ষণ খোটা দেয় তুমি আমার ছেলেকে একটি ছেলে দিতে পারলে না।এ না পারার যন্ত্রনায় মেয়েটি ডিপ্রেশন এ ভুগছে।আমি তাকে বললাম তুমি তোমার শ্বাশুড়ীকে বলো যে আপনার ছেলেকে বলুন আমাকে একটি ছেলে সন্তান উপহার দিতে। সে আতকে বলে সেটি কেমনে বলি।আমি তাকে বুঝিয়ে দেই কিভাবে ওয়াই ক্রমোজমের কারনে ছেলে সন্তান হয় এবং সেটি একমাত্র পুরুষ/ স্বামীর কাছ থেকেই আসতে পারে, স্ত্রীর  কাছ থেকে নয়।আপনারা সবাই কি সকল স্বামী ও তাদের আত্মীয়দের এই বৈজ্ঞানিক তথ্যটি জানিয়ে দেবেন?
৩। যাই হোক বর্তমানে এই রোগীনির ব্যাপারটি আর নিছক মনো- সামাজিক সমস্যায় সীমিত নেই।এটি একটি মানসিক রোগে দাড়িয়ে গেছে,যার ভালো চিকিৎসা রয়েছে। আমি তাকে ও তার মাকে নিরাশ করিনি।তাদের যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে আশ্বস্ত করেছি

No comments:

Post a Comment