চেম্বারে মাসে ৪-৫টি জ্বীন-ভূতে ধরা রোগী পাই।এমনকি সাইকোটিক রোগীদের ভিতরেও কেমনে জানি জ্বীন ঢুকে পড়ে( মানসিক রোগের উপর দেশ- কাল- সংস্কৃতি যে ভূমিকা রাখে এটি তার প্রমান)।
এতো কাহিনীর মধ্যে আজ একটি কাহিনী শেয়ার করবো,কেননা এই কেইসের রোগীনী একজন শিশু মেয়ে ও এই কেইসে ধারনা মিলবে কত সহজে বিশ্বাস দ্রত অন্যদের মন- ব্রেইনে সংক্রামিত হয়।
কাহিনী: সুশ্রী, মিস্টি চেহারার মেয়ে সামিয়াকে হুজুর বাবা ও মা চেম্বারে নিয়ে আসলো।প্রধান লক্ষন হলো রাত ১২ টায় ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করে,হাত পা মোচরাতে থাকে,আবোল তাবোল কথা বলে,চিৎকার করে,পরে ঘুমিয়ে পড়ে।
ইতিহাস নিয়ে যা জানলাম:৬-৭ বছর পূর্বে সামিয়ার বয়স যখন ৫, তখন তারা নতুন বাসায় আসে।বাড়ীর মালিক নারায়নগন্জ থাকে,এটি মুন্সী গন্জে।৫-৬ বছর বাড়িটি আবদ্ধ ছিল।প্রথম দিন নাস্তা করার সময় তারা শুনতে পেলো কে যেন দরজায় নক করছে।তখন বাবা,মা,নানা,নানী ও সামিয়ারা দুই বোন সেখানে ছিল।বাবার দাবী শব্দটি সবাই শুনে।দরজা আটকানো ছিল এবং দরজার কয়েক গজ পর মেইন গেইটে তালা দেওয়া।তাই কারো পক্ষে আসা সম্ভব না। কিছুক্ষন অপেক্ষার পর আরো জোরে নক করতে লাগলো।আমি উঠে দরজা খুলে দেখে কেউ নেই।পরের দিন আবারো দরজায় নক হয়( শব্দ করে) কিন্তু আমরা কাউকে দেখি না।এরপর প্রতিদিনই তেমন হতে থাকে।
তিনি বলেন আমরা যে রুমে যাই সে রুমেই দড়াম দড়াম শব্দ শুনি।রান্না ঘরে ও শব্দ শুনি যেন কেউ পাতিল মেঝেতে ফেলছে।মনে হয় রাতে কেউ দরজায় লাথি মারছে।বাসায় যারা আসে সবাই এই শব্দ শুনে।এ সময় আমরা দোয়া দরুদ পড়তাম।এ কথা কাউকে বলিনি।
১ মাস পর পাশের বাসার মহিলা এসে বলে আপনাদের এই সাইডটা ভালো না।অথচ আমরা কিন্তু উনাকে বা বাইরের কাউকে এ ব্যাপারটি জানাইনি।
এ রকম শব্দ শুনে মনে ভয় আসতো যে এ ঘর দীর্ঘ ৬ বছর আবদ্ধ ছিল,বোধ হয় কিছু একটা এখানে রয়েছে।এ সময় আমরা কোরআন পড়তাম,আজান দিতাম।তিনি বলেন এটি পুরনো হিন্দু বাড়ী ছিল,কাছেই শশ্মান খোলা।
বাইরে কয়েকটি গাছ ছিল।কয়েকদিন নিজ বাড়ী থেকে ফিরে দেখি দুটি নারিকেল গাছ পুড়ে গেছে।কারা করেছে জানি না।এটি ওদের কাজ মনে হলো।আরো দেখি জানালার পাশের ওয়ালে ৫-৬ টি ছোট পায়ের ছাপ।মাটি মাখা পা দিয়ে হাটলে যে রকম ছাপ পড়ে সেরকম।শুধু আমরা নই আমাদের শ্বশুর শ্বাশুড়ী ঐ পায়ের ছাপ দেখে।
এভাবে শব্দ,টোকাটুকি চলছেই।
৩ বছর পর এই মেয়ে সামিয়ার সমস্যা শুরু হয়।হঠাৎ রাতে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসে,আব্বু আম্মু ডাকতো,জানালা,ওয়ালের দিকে ভীত নয়নে তাকাতো ও আঙ্গুল দিয়ে কিছু দেখাতো।আমাদেরকে জাপটে ধরতো ও চিৎকার করতো।ঐ সময় মেয়ের শরীর শক্ত থাকতো। আমরা দোয়া দরুদ পড়তাম।১৫-৩০ মিনিটের মধ্যে আবার ঘুমিয়ে পড়তো।তখন শরীর নরম হয়ে যেতো।
সকাল বেলায় সামিয়া এর কিছু মনে করতে পারতো না।
১ বছর এভাবে চলে,শুধু দোয়া দরুদ পড়তাম।
বাড়ীর মালিককে জানাই তিনি বলেন অনেকদিন আবদ্ধ ছিল,দেখেন দোয়া দরুদ পড়ে কিছু হয় কিনা।এরপর ঐ মালিকের বাড়ীতেও কে যেন জানালার পাশে এসে দাড়িয়ে থাকে।তাদের বদ্ধ জানালা দিয়ে পর্দা বাইরে টেনে নিয়ে যেতো।
( পরে ওনারা কবিরাজ ঢেকে সেটি থেকে মুক্ত হয়)।
এসব শুনার পর দু'তলায় রান্না করতে যাই,তখন সামিয়া ড্রইং রুমে একটি চেয়ারে বসেছিল।সে দেখে কালো রূপে এক মানুষ দাড়িয়ে আছে,সে চিৎকার করে এসে আমাদের বলে, কিন্তু আমরা কিছু দেখি না।দোয়া দরূদ পড়ি।এর ২০ -২৫ দিন পর নীচ তলায় সে একা বসা।সে দেখে বদ্ধ জানালার দুই কপাটের মাঝখান দিয়ে কালো মানুষটি বাইরে চলে যায়।
এর মধ্যে রাতের ব্যাপারটি বেড়ে যায়।বেশীরভাগ সময় ঠিক রাত ১২ টায় ঘটনা ঘটতো।২-৩ ঘন্টা থাকতো।প্রথমে ঘুম থেকে উঠে কেদে উঠতো,এদিক ওদিক তাকাতো,কখনো মা বাবাকে ঢেকে উঠাতো।এই সময় আবোল তাবোল বকতো। মা তাকে নাম কি, কেন এসেছো জিজ্ঞেস করলে বলতো আসমা,জেসমিন ইত্যাদি।তারা নাকি ৭-৮ জন। বলতো আমাদের এখানে আটকে রাখা হয়েছে,চালান দিয়ে রেখেছে।
১ বছর পর ঐ জ্বীনদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কবিরাজের কাছে যাই।উনি বৈঠকে বসেন, তুলা রাশির লোক দিয়ে জ্বীন ঢেকে আনেন( ঐ ব্যক্তিরা সবাই হন ঐ কবিরাজেরই লোক)। জ্বীন বলে আমাদের এখানে আস্তানা। এই বাড়ীর উপর দিয়ে আমরা যাতায়াত করি।এখানে এসে জিরাই।কবিরাজ পানি পড়া,তেল পড়া ও তাবিজ দেন। তেমন ফল পাই না।
এভাবে ৭ জন কবিরাজের কাছে যাই।৫ম জন বলেন এই জ্বীন চালান করা( চালান মানে শত্রু পক্ষকে ডিস্টার্ব করার জন্য জ্বীন পাঠানো, যা কুফরি কালাম পড়ে করা হয়)। তাহলে কি বাড়ীর মালিক এসব করছে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য? মালিককে বলি,তখন তিনি বলেন আগে যে মহিলা এখানে ছিল তাকেও জ্বীনরা জ্বালিয়েছে।
কবিরাজরা এ পর্যন্ত বাড়ীতে ৯ টি তাবিজের সন্ধান পায়। তুলা রাশির লোক দিয়ে মাটি খুড়ে এগুলো পাওয়া যায়।দুজন কবিরাজ আমাদের বাড়ী বন্ধক করে দেয়। (ঘরের চারকোনায় চারজন দাড়ান।চারজন আজান দেন ও গর্ত করে চার কোনায় চারটি তাবিজ পুতে রাখেন) । সরিষা পড়ে ফু দিয়ে বাড়ীতে ছিটিয়ে দেয় যাতে মন্দ জ্বীন চলে যায়।
এ পর্যন্ত পৌনে দুই লাখ টাকা কবিরাজের পিছনে খরচ হয়ে যায়।
আরো কিছু অলৌকিক কান্ড ঘটে।এক কবিরাজ এখানে চিকিৎসা করতে আসার সময় এক্সিডেন্ট করে হাত ভেঙ্গে ফেলে; আরেকজন আসার সময় পড়ে গিয়ে কোমড় ভেঙ্গে ফেলে; তৃতীয় জন আসার সময় শুনে তার মা হঠাৎ করে খুব অসুস্হ হয়ে পড়েছেন।পরে তার মা সুস্থ হলে তিনি আবারো আসতে চান।তখন তার নামে কিছু লোক মিথ্যে মামলা দেয়।তখন সে বলে আমি এ কাজ আর করবো না,এরা খুব খারাপ জ্বীন।
এক পর্যায়ে স্কুলের এক মাস্টার বলেন অভিজ্ঞ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এর কাছে যান।এটি বোধ হয় কোন রোগ।
এরপর স্যার আপনার সন্ধান পাই।বিশেষ করে আপনার কার্ডে লেখা জ্বীন- ভূতের চিকিৎসা করেন, তাই মনে হলো আপনি পারবেন।
চিকিৎসার পর সামিয়া ৪-৫ মাস ভালো ছিল।কিন্তু কয়েকদিন হলো আবারো সে রাতে উঠে কাদে,বলে আমার নাম আসমা,আমাকে এখানে আটকে রেখেছে।
নতুন করে চিকিৎসা শুরু করি
পর্যবেক্ষণ :
১। সামাজিক মিথ -আবদ্ধ ঘর,শশ্মান খোলা মানে ভুত প্রেতের আড্ডা খানা( বাবার অবচেতন মনে এ ভয় কাজ করছিল)
২। বিশ্বাস ভাইরাসের মতন ছড়ায়( মালিকের বাসায় ও জ্বীনের উৎপাত,আবার তাদের কালো মানুষ সামিয়া ও দেখা শুরু করে)
৩। পানি পড়া,তেল পড়া ও ঘর বদ্ধ করা কমন প্রাকটিস
৪। এই ভাইরাস শিশু মনেও প্রবেশ করে
৫। কোরআন এ জ্বীন এর কথা উল্লেখ আছে।তাই জ্বীন জাতি বলে একটি কিছু আছে।তবে মানসিক রোগ সৃষ্টির কারনএই জ্বীনের আছর নিয়ে সামাজিক বিশ্বাস, মিথ।জ্বীন ভুতের সঙ্গে সম্পর্কিত এ সব মিথ, বিশ্বাস না ভাঙ্গতে পারলে এরকম ব্যাধির অবসান হবে না
No comments:
Post a Comment