পর্ব-২:
গত পর্বটি লিখেছিলাম আমার প্রকাশিতব্য বই " সুখী মানুষ" থেকে।
এ পর্ব লিখবো আমার ইতিমধ্যে প্রকাশিত ও সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া আত্ম নির্মান বিষয়ক বই " মন ও মানুষ" থেকে।
এই বইয়ের শেষ অধ্যায় " মন- বস্তু -চেতনা- আত্মা:মহাবৈশ্বিক বিবর্তনের ইতিকথা " থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি ।( লেখা বড় মনে হলে ২,৩,ও৬ অংশ না পড়লেও চলবে-)
১। " the most human thing in human is it's brain"। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে সবচেয়ে " মানবীয়" ব্যাপারটি হচ্ছে তার ব্রেইন।"
প্রতীকি আবিষ্কার" ( symbolic invention) এর মতন উচ্চ মার্গের ক্ষমতা একমাত্র মানুষেরই রয়েছে। বিমূর্ত ভাবনা,চিন্তা ও কল্পনার জগতে প্রতীকি ধারনা সমূহকে নিয়ে গভীর গবেষনার ফলশ্রুতিতে মানুষ মহাবিশ্বের সৃষ্টির রহস্য, মহাবিশ্বের নিয়ম- কানুনসহ নিজকে জানার কাজটিও অনেকটা সমাধা করতে পেরেছ। সেই সঙ্গে তৈরী করতে পেরেছে দর্শন,সাহিত্য, শিল্পকলা, চিত্রকলা,সঙ্গীত সহ একটি মহত্তম সংস্কৃতি।অন্য কোন প্রানী এমন নান্দনিক সুসভ্য সংস্কৃতি তৈরী করতে পারেনি।
তাই মানুষ শ্রেষ্ঠ, কেননা সে উন্নত সংস্কৃতি তৈরী করতে পারে,অন্য প্রানীরা তা পারে না।
২।( না পড়লও চলবে) কিভাবে আমরা মানুষ হয়ে উঠলাম তা জানতে হলে মহাবিশ্বের বিবর্তন আমাদের জানতে হবে।
প্রায় ১৫ শত কোটি বছরের সেই বিবর্তনের ইতিহাস অনেক লম্বা।
অতি সংক্ষেপে বললে:
সিনগুলারিটি বা বিন্দু বিশ্ব " বিগ ব্যাং" এর মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়
>মৌলিক বলগুলো মুক্ত হয়
> শক্তি থেকে বস্তুর সৃষ্টি হয়
> কোয়াক- বিপরীত কোয়াকের সৃষ্টি হয়
>প্রোটন ও নিউট্রন এর সৃষ্টি হয়
>বিপরীত প্রোটন ও বিপরীত নিউট্রন সৃষ্টি হয়
> প্রোটন- নিউট্রন মিলে ডুয়েটেরিয়াম এর সৃষ্টি
> হিলিয়াম
> হাইড্রোজেন
> এই হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম হচ্ছে সমগ্র মহাবিশ্বের মূল বস্তু কনা
> ১০০ কোটি বছর যাবৎ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম মিলে তৈরী করে বিভিন্ন গ্যালাক্সি ( যার মধ্যে নক্ষত্র,গ্রহ, উপগ্রহ ও রয়েছে)>
৩। ( না পড়লেও চলবে)এই বস্তু বিবর্তন এর পর শুরু হয় ২য় ধাপের বিবর্তন - প্রানের বিবর্তন > ( এটি সাধারন বিবর্তন ছিল না,এটি ছিল বিবর্তনের গুনগত পরিবর্তন)
> কেননা নতুন বিল্ডিং ব্লক শুরু হলো- ডিএনএ- এমন বস্তু যে নিজে নিজের প্রতিরূপ তৈরী করতে পারে( শুরু হলো বিবর্তনের নতুন পালা)
> পৃথিবী সৃষ্টির ১৫০ কোটি বছর পরই ডিএনএ ও প্রোটিন এর সমাহারে তৈরী হয় এক আদি ভাইরাস
> ২০০ কোটি বছর পর পরিপূর্ণ এক কোষী জীব
> ১৬০ কোটি বছর পূর্বে বহুকোষী সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রানী>
এ পর্যায়ে বিবর্তন কিছুটা গতি পায় > যাকে বলা হয় ক্যাম্বিয়ান বিস্ফোরন
> আসে প্রথম মেরুদন্ডী প্রানী মাছ
> এরপর পতঙ্গ,উভচর প্রানী,বৃক্ষ, সরীসৃপ, ডাইনোসর, স্তন্যপায়ী এদের উদ্ভব
এরপর
> প্রাইমেট>
>এ্যানথ্রোপয়ডিয়া
>হোমিনয়ডিয়া
> হোমিনিড
> হোমোইরেকটাস
> নিয়ানডার্থাল
> ক্রোম্যানিয়ন
>সর্বশেষে প্রাজ্ঞ মানব হোমোসেপিয়েন্স এর আবির্ভাব।
অতি সংক্ষেপে এই হলো আমাদের বিবর্তনের চিত্রলেখ।
পর্ব-১ এ দেখিয়েছি এই মানুষ হতে গিয়ে মানব ব্রেইনের কি কি উন্নতি হয়েছে।কিন্তু শুধু ঐ মেধার কারনে মানুষ শ্রেষ্ঠ হয়নি,হয়েছে তাদের নান্দনিক সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য।
৪। এটি বিবর্তনের ৩য় ধাপ ও এটি গুনগত মানে ভিন্ন।
সম্ভবত এখানেও নতুন বিল্ডিং ব্লক তৈরী হয়েছে এবং সেটি মন- মননগত।
অন্য প্রানীদের খাদ্য সংগ্রহ,আত্ম রক্ষা ও বংশবিস্তার এই ৩ কাজে তাদের জীবন সীমিত।মানুষ ঐ ৩ কাজের বাইরেও কিছু করে থাকে। মানুষ তার নতুন বিবর্তনে বিল্ডিং ব্লক হিসেবে পেয়েছে " মন ও চৈতন্য " নামে অনবদ্য প্রক্রিয়াকে।
সে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছে উচ্চ নৈতিকতা,মানবিকতা,উচ্চ বৌদ্ধিক ও কল্পনা করার ক্ষমতা ও উন্নত সংস্কৃতি নির্মানের ক্ষমতার জন্য।
মানুষের ব্রেইনে মন- মনন- চেতনা নামক নতুন বিল্ডিং ব্লক মানুষকে শুধু বুদ্ধিমত্তা নয়,নৈতিক,সাংস্কৃতিক ও মানবিক দিকে এক অনন্য বিকাশের সুযোগ করে দেয়।
তবে নতুন মাত্রার এই বিবর্তন কি সবার মাঝে ছড়াতে পেরেছিল বা পেরেছে? আমরা কতজন সুসভ্য, সংস্কৃতিবান, মননশীল, উচ্চ মূল্যবোধ সহ মানবিক গুনাবলী অর্জন করেছি?
সমগ্র পৃথিবী কোন প্রকৃতির মানুষ শাসন করছে?
আমাদের রাস্ট্র,সমাজ,প্রশাসন সর্বত্র কাদের কর্তৃত্বে চলছে?
সৎ,মেধাবী,সৃজনশীল মানুষগুলো কতটুকু সম্মান,গুরুত্ব পাচ্ছে,
তারা সমাজ নির্মানে আদৌ কোন ভূমিকা কি রাখতে পারছে?
উত্তর আমাদের সবার জানা।
এই অধপতিত অবস্হা নিশ্চয় হতো না যদি নবতর সে বিবর্তন সব মানুষের মধ্যে সমভাবে হতে পারতো।
যেহেতু এবারের বিবর্তন কেবলমাত্র প্রাকৃতিক নয়,এটি বিশেষ মাত্রার অন্য রকম বৈশিষ্ট্য মন্ডিত বিবর্তন,তাই এর বিকাশ ত্বরান্বিত করতে হলে সমাজ,রাস্ট্রের সর্বত্র সেই বিকশিত মানুষ গুলোর প্রাধান্য থাকতে হবে।
৫। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন হয়েছে।মেধা ও মননে মানব জাতি আড়াই - তিন হাজার বছর পূর্বে যেখানে ছিল তা থেকে কতটুকু আমরা এগুতে পেরেছি?
কবি আল মাহমুদ এর সে বিখ্যাত উক্তি এখন ও প্রযোজ্য " কতটুকু এগুলো মানুষ? "
খ্রীষ্টপূর্ব ৭ম ও ৬ষ্ট শতাব্দীতেই পৃথিবীতে এক বিষ্ময়কর সভ্যতার উদ্ভব হয় যার নাম " আয়োনীয় সভ্যতা "।
যা ছিল কুসংস্কার ও ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত।
৬। ( না পড়লেও চলবে)মাত্র একটি লাঠি ব্যবহার করে এবোটাস থেনেস সর্ব প্রথম পৃথিবীর পরিধি বের করেছিলেন;
থেলিস সূর্যগ্রহণ সম্বন্ধে জানতেন ও পিড়ামিডের ছায়ার দৈর্ঘ্য থেকে এর উচ্চতা মেপেছিলেন;
হিপ্পোক্রিটাস চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটান;
এম্পোডিকিলিস ডারউইনের অনেক আগেই বিবর্তনের ধারনা দেন;
ডেমোক্রিটাস " পরমানুর" ধারনা দেন ও নিউটনের অনেক আগেই " সীমা তত্ব" আবিষ্কার করেন এবং ডিফারেনশিয়াল ও ইন্ট্রিকাল ক্যালকুলাস আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গিয়েছিলেন:
এরিস্টারকাস কোপার্নিকাস এর অনেক আগেই বলেন পৃথিবী নয় সূর্য গ্রহ ব্যবস্হার কেন্দ্র - ইত্যাদি
অথচ প্লেটো,এরিস্টটল এসে এই মহান সভ্যতার বিপরীত ধারা শুরু করেন।
শুরু হলো হাজার বছরের " মধ্য যুগীয় অন্ধকার"।
যদি সভ্যতার ঐ ধারা অব্যাহত থাকতো তাহলে হয়তো ৫০০ বছর পূর্বেই আইনস্টাইন এর আপেক্ষিক তত্ব আবিষ্কৃত হতো,আমরা আন্তঃনাক্ষত্রিক অভিযান করতে পারতাম।
৭। মাঝখানের অন্ধকার মধ্য যুগের পর আবারো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ শুরু হয়েছে বটে,
তবে মনন ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমরা সেই ৫ হাজার বছরের আগেকার স্তর থেকে আদৌ কোন অগ্রগতি করতে পেরেছি কি?
এ না পারার কারন সম্পদ ও ক্ষমতা রয়ে গেছে মানবিকতা বর্জিত,স্বার্থপর, সৃজনশীলতা বন্চিত,কৌশলী, ধূর্ত কিছু চতুর মানুষের হাতে।
সৃজনশীল, জিনিয়াস,মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষগুলোকে এরা কোনঠাসা করে পিছিয়ে রেখেছে।
যেহেতু এটি পূর্বতন ভৌতিক বিবর্তন নয়,তাই স্বল্প সংখ্যক গুনী ব্যক্তি এই উচ্চতর মন- ব্রেইনের অধিকারী হয়।
এই দার্শনিক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি সহ যে সব মহতি মানুষগন এসেছেন, তাদের মেধা,মনন ও শ্রমের ফসল আজকের উন্নত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির ধারা।
কিন্তু এদের ফসলকে ( সম্পদ,প্রযুক্তি)কুক্ষিগত করে ফেলে চতুর,ধূর্ত,কৌশলী,স্বার্থান্ধ কিছু মানুষ। সমাজ,রাস্ট্রের কর্তৃত্ব তারা কব্জা করে নেয়।যুগের পর যুগ এভাবেই চলছে।
শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার( যিনি ঢাকা কলেজে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন) মানুষকে দুভাবে ভাগ করেন:
১। সাম্প্রতিক মানুষ: এরা সম- সাময়িক জীবনের জন্য বাচে।এই এক জীবনে যতটুকু ভোগ বিলাস,বৈষয়িক উন্নতি তার জন্য সকল মেধা বুদ্ধি কাজে লাগায় ( ঐ ক্ষমতা কুক্ষিগত করা লোকগুলো ও আমজমতা)- এরাই গরিষ্ঠ সংখ্যক
২। চিরায়ত মানুষ: এরা বৈশ্বিক সত্বার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে।নিছক বৈষয়িক অর্জনের পিছনে ছুটে না।মানব কল্যাণ ও সভ্যতা নির্মাণ যাদের ব্রত।এরা মাইনরিটি
পবিত্র গ্রন্থ বেদেও মানুষকে ৩ ভাগে ভাগ করেছে :
সাত্ত্বিক মানুষ - এরা হচ্ছে ঐ চিরায়ত মানুষ ;
রাজসিক মানুষ -ঐ ভোগবাদী,চতুর, সমসাময়িক মানুষ ;
ও তামসিক মানুষ - দারিদ্রতা,অশিক্ষায় নিমজ্জিত সাধারন মানুষ।
অল্প কিছু সংখ্যক রাজসিক মানুষের পিছনে থাকে তাবৎ তামসিক মানুষ ( আমজনতা)। বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র অংশটি হচ্ছে সেই স্বাত্বিক বা চিরায়ত মহান মানুষ গুলো।
মানবীয় বিবর্তন নির্ভর করে ঐ চিরায়ত,সাত্ত্বিক মানুষদের উপর।কিন্তু সমাজে এদের সংখ্যা কত? সমাজে এদের প্রভাব কতটুকু?
ঐ চতুর সাম্প্রতিক মানুষগুলোর তাঁবেদারি করছে বেশীরভাগ মানুষ।
সামান্য বৈষয়িক স্বার্থ হাসিলের জন্য,
কিছু সুযোগ সুবিধা বা আনুকুল্য পাওয়ার লোভে
বা হয়রানির ভয়ে
অনেক চাটুকার তাদের আনুগত্য করে থাকে।
ঐ চিরায়ত মানুষ গুলো উল্টো লান্চিত হচ্ছে,অপমানিত হচ্ছে ও মূলধারার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই মানবীয় নতুন বিবর্তন গতি পায়নি ও পাচ্ছে না।
এই গতি ত্বরান্বিত করতে চাইলে
ন্যায়ভিত্তিক,সাম্য ও মানবিক সমাজ ব্যবস্হা অপরিহার্য।
গুনী মানুষ, সৃজনশীল, মননশীল মানুষ, উচ্চ সংস্কৃতিবান, উচ্চ মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষকে যথাযথ সম্মান পূর্বক সমাজ, প্রশাসন,রাস্ট্রে ভূমিকা রাখতে না দিলে এই নতুন মাত্রার বিবর্তন গতি পাবে না
বরং উল্টোটিও ঘটতে পারে।
আমরা কি পারবো সভ্য, সংস্কৃতিবান,সৃজনশীল, মেধাবী মানুষকে লালন করতে,সমাজ রাস্ট্রীয় কাঠামোর শক্তিকেন্দ্রে তাদেরকে স্হান করে দিতে?
No comments:
Post a Comment