এক দম্পতির ১১ বছর বয়সী এক মেয়ে ছিল "সেরিব্রাল পালসির" রোগী। এ ধরনের রোগী একদলা মাংস ছাড়া আর কিছু না।মানসিক প্রতিবন্ধীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে এ রোগ।হুইল চেয়ারে ঐ মেয়েকে নিয়ে তারা ট্রেনে করে যাচ্ছিল।হঠাৎ ট্রেনটি দুর্ঘটনায় ব্রীজ ভেঙ্গে নদীতে পরে যায়।যখন কামরায় পানি দ্রুত বেগে ঢুকতে লাগলো তখন ঐ মা বাবা জানালা দিয়ে কোন রকমে ধাক্কা মেরে ঐ প্রতিবন্ধি মেয়েকে উদ্ধার কর্মীদের কাছে ফেলে দেয়।এর পর পরই তারা দুজন ডুবে মারা যান।
যে সন্তানের কোন ভবিষ্যত নেই, তারা না থাকলে যার বেচে থেকে ও লাভ নেই, তবুও মা বাবা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে ঐ প্রতিবন্ধী মেয়ের জীবন রক্ষার জন্য।
বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানীদের মতে সন্তানদের প্রতি মা বাবার এরকম চরম আত্ম ত্যাগের পিছনে রয়েছে " প্রজনন সফলতার "(reproductive success) তাগিদ। অর্থাৎ এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে বংশধারার " জিন" সন্চালিত করে দেওয়ার তাগিদ।
কিন্তু আসলেই কি এটি নিছক তেমন স্বার্থপরতা?
মূলত ক্রাইসিস মুহূর্তে মা বাবার এ এরকম আত্মত্যাগ "নিখাদ ভালোবাসা " ছাড়া আর কিছু নয়।
এটি হচ্ছে "পরহিতের জন্য ভালোবাসা " (এলট্রুস্টিক লাভ)।
এতে প্রমানিত হয় আমাদের গভীরতম অনুভূতি, অনুরাগ ও আকাঙ্খাগুলো হচ্ছে আমাদের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় গাইড।মানব অস্তিত্ব টিকে থাকার পিছনে এসবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
এই ক্ষমতা অতুলনীয়। একমাত্র নিখাদ ভালবাসা ছিল ঐ সন্তানকে রক্ষা করার আন্তরিক তাগিদ,যা নিজেদের রক্ষা করার তাড়নাকে দমিয়ে রেখেছে।
নিছক বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে দেখলে এই আত্মত্যাগ ছিল অযৌক্তিক( ইররেশনাল)। কিন্তু অন্তর দিয়ে দেখলে এটি ছিল একমাত্র "চয়েজ" যা তারা নিতে পারতো।
যখন তীব্র আবেগ যুক্তিকে হারিয়ে দেয়ঃ
"মানুষ সঠিক ভাবে দেখতে পারে (শুধু) হ্রদয় দিয়ে (চক্ষু দিয়ে নয়)। যা কিছু অত্যাবশ্যকীয় তা তা চর্ম চোখে অদৃশ্য থাকে "- antoine De Saint Exuoprey
আমাদের বিবর্তনের আবেগীয় ইতিহাস হচ্ছে " ভয়"। এই ভয়ের কারনে আমরা পরিবারকে ও নিজকে বিপদ থেকে রক্ষার জন্য শক্তি সামর্থ্য জড়ো করি।
বিপদের সময় তাৎক্ষণিক ভাবে স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়া দেওয়ার প্রবনতা, আমাদের স্নায়ু সিস্টেমে গ্রোথিত রয়েছে।
আদিমকালে মানব পূর্ব পুরুষরা এমন ক্রান্তিকাল কাটিয়েছে, যখন তারা শুধু "অস্তিত্ব ও মৃত্যুর " পার্থক্য বুঝতো।
একই সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে ভাবতো যারা তাদের বংশধারা অব্যাহত রাখবে।
এসব কারনে যখন নিজের বা পরিবারের কারো অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হতো, তারা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া করতো নিজেদের রক্ষা করার জন্য।
এই আদিম প্রবৃত্তি এখনো আমাদের স্বভাবে দৃড়মূল হয়ে রয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে সমাজ সভ্যতার এতো অগ্রগতি হয়েছে যে পুরনো বিবর্তনের গতি তাকে ধরতে পারছে না।
আমরা বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে যতো অগ্রসর হচ্ছি সাংস্কৃতিক, মানবিক দিক থেকে তত অগ্রগতি হয়নি।
কিছু কিছু সামাজিক নিরোধমূলক নৈতিকতা সমাজ গ্রহণ করেছে বটে, তবে তা আমাদের মূল প্রবৃত্তি দমনে তেমন কার্যকর নয়।
আমরা এখনো আবেগীয় প্রতিক্রিয়া করি হাজার হাজার বছর আগেকার প্রকৃতি অনুযায়ী, আধুনিক সভ্যতায় যেমন হওয়া উচিত ছিল তেমনভাবে নয়।
মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড তার " Civilization and It's discontents" -বইতে উল্লেখ করেন,
সমাজকে বাহির থেকে "রীতি -আইন - কানুন" প্রয়োগ করতে হয়েছে যাতে মানুষ তার অতিরিক্ত "আবেগের ঢেউকে" সামলে রাখতে পারে।
এইরকম "সামাজিক নিরোধ" ব্যবস্থা থাকা সত্বেও প্রায়ই যুক্তির চেয়ে তীব্র আবেগ /প্রেষনা আমাদের প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে।
মানুষ কেন এরকম প্রকৃতির হলো?
এর কারন হচ্ছে মানুষের "মানসিক জগতের আর্কিটেকচার বা স্থাপত্য নকশা"।
এগুলো হচ্ছে আমাদের আবেগের "বেসিক নিউরাল সার্কিট্রি"।
আমরা জন্ম গ্রহণ করি সেই সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যেগুলো ৫০ হাজার প্রজন্মের আগে মানুষের জন্য সর্বোত্তম ছিল। তখন পশুর সঙ্গে পাশবিক আচরণ করেই মানুষকে টিকে থাকতে হতো।
অথচ আমরা ভাবি আমরা জন্ম গ্রহণ করি গত কয়েক প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
মানুষের আবেগীয়,সাংস্কৃতিক ও মানবিক বিবর্তন এর হার হচ্ছে খুবই শ্লথ গতিতে,কিন্ত আমাদের বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশ হচ্ছে তার চেয়ে সহস্র গুন বেশি হারে।
গত ১০ হাজার বছরে মানব সভ্যতার দুরুত অগ্রগতি হয়েছে এবং জনসংখ্যা ও বিপুল হারে বেড়েছে ( ৫০ লক্ষ থেকে ৭০০ কোটি) ।
কিন্তু এসব অগ্রগতির খুব কমই " দাগ" পড়েছে আমাদের জৈবিক কাঠামোতে ও আবেগীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে।
তাই বিস্মিত হওয়ার কারন নেই এটা ভেবে যে, মানুষ এখনো কেন এতো নিষ্ঠুর, নির্মম,অমানবিক ও পাশবিক আচরণ করে।
আমরা বিবর্তিত হচ্ছি খুবই ধীর গতিতে,যে গতি বাড়াতে পারতো সমাজ,রাস্ট্রের নির্ধারকেরা।
মানবিক, সংস্কৃতিবান,হ্রদয়বান ও সৃজনশীল মানুষ যদি সমাজ, প্রশাসনের সর্বস্তরে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকতে পারতো, তাহলে এই "মানবিক বিবর্তন " আরো জোরদার গতিতে হতে পারতো।
কবে পাবো সে সমাজ,
কবে তৈরি হবে সে মানবিক জৈবিক কাঠামো?
(পর্ব-৪ঃআসছে)
No comments:
Post a Comment