কাহিনী সংক্ষেপঃ
আজাদ সাহেব, বয়স ৪৬ বছর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।১০ বছর যাবত তিনি এই রোগে ভুগছেন। 
বিয়ের আগ থেকেই উনার সমস্যা দেখা দেয় যে উনি একা ঘরে ঘুমাতে ভয় পেতেন এবং এর জন্য সব সময় সঙ্গে লোক নিয়ে ঘুমাতে হতো।
তার এই ভয় এখনো আছে।বউ ছাড়া একা ঘুমাতে পারেন না।
এর কিছু দিন পর তিনি শরীরে চিন চিন ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেন,ক্রমশ যা অসহ্য যন্ত্রনায় রূপ লাভ করে।
পুরো শরীরই যন্ত্রনা করতো। তবে বেশি হতো হাতে। দিনে মোটামোটি থাকতো, এমনকি ঘুমাতে যেতো ভালই। কিন্তু মাঝ রাতে বা শেষ রাতে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে জেগে যেতো।
এরপর আর ঘুম আসতো না।বউকে বলতো শরীর টিপে দিতে। বউ সারা রাত হাত পা শরীর টিপতে থাকতো। সকাল ৯-১০ টার দিকে ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পরতো।
তিনি আরো জানান শরীরে শক্তি পাই না,ভারী কিছু হাত দিয়ে উঠালেও হাতে টের পাই না,মাংসপেশিতে চাপ লাগে না।
টেনশন করলে যন্ত্রনা বাড়ে তবে কাজ করলে ভাল থাকি। ঘুম হয় না,অস্হির লাগে। 
একসময় ব্যথা তীব্রতর হয়।সীমাহীন যন্ত্রনা।
দেশের বিখ্যাত সব মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, নিউরো বিশেষজ্ঞ, হাড়-বাত বিশেষজ্ঞ গনকে দেখানো হয়।এ হেন টেস্ট নাই করা হয় নাই।
কিন্তু বড় বড় ডাক্তাররা বলে রিপোর্ট ভাল, আমার কোন রোগ নাই।
এরপর আত্মীয়দের পরামর্শে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান। সেখানকার ডা. তাকে দেখে বলেন,আপনার ঐ ধরনের মারাত্মক কোন রোগ হয়নি। তেমন হলে এতো দিনে মারা যেতেন,সিঙ্গাপুরে আর আসতে পারতেন না
আপনার এটি মানসিক রোগ।
তিনি মাত্র একটি ঔষধ লিখে দেন( পারক্সেটিন- যা একটি এন্টিডিপ্রেসেন্ট)।
এই একটি ট্যাবলেট খেয়েই তিনি ২-৩ বছর ভাল ছিলেন। 
কিন্তু এখন আবার ও সে যন্ত্রনা ফিরে এসেছে।
তবে টাকার অভাবে সিঙ্গাপুর যেতে পারছেন না এবং ঐ আগের ঔষধে তেমন কাজ করছে না।
আমাকে বললো, স্যার আপনার অনেক সুনাম শুনে এসেছি, আপনি নাকি ভাল কাউন্সিলিং করেন।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম ঐ যন্ত্রনার সময়ে আপনার মন কেমন থাকতো?
তিনি বলেন -অস্থির, অশান্তি লাগতো।বউ বলে খিটখিটে মেজাজ হয়ে যেতো।
মনে আনন্দ, ফুর্তি থাকতো না;
কাজে আগ্রহ পেতো না,
ঘুম হতো না;
কোন কিছু নিয়ে ভাবলে ব্যথা শুরু হতো ও বেশি হতো ;
(যেমন-কেউ খারাপ ব্যবহার করলে, কেউ খামোখা ঝগড়া বাধালে,বউ বাচ্চাদের বকা দিলে বা সংসারের কাজে অবহেলা করলে) । 
বউ বলে- 
সে দায়িত্বের প্রতি সিরিয়াস ;
নিয়ম কানুন না মানলে ক্ষেপে যায়;
বাচ্চাদের ধমক দিতে দেয় না, 
সময় মতন কাজ না করলে রেগে যায় 
এবং বাচ্চাদের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে বলে উদ্বিগ্ন থাকে। 
তবে একটি ব্যতিক্রমী লক্ষণ তিনি উল্লেখ করেন যে, ঐ যন্ত্রনার সময়ে ও ওনার যৌন চাহিদা বেশি থাকে, যা তার বউও স্বীকার করে।
কেইস হিস্ট্রি থেকে কি শিখলাম?
১। মানসিক রোগ মানে তথাকথিত পাগলামি নয়।সবদিক থেকে স্বাভাবিক মানুষ ও মানসিক রোগী হতে পারে। মানসিক রোগীদের মাত্র ১% সাইকোসিস বাকি ৯৯% হচ্ছে এরকম স্বাভাবিক মানুষ।
২। ব্যথা - মানসিক রোগের একটি অন্যতম লক্ষণ।
অনেক মানসিক রোগে শারীরিক ব্যথা /যন্ত্রনা থাকতে পারে। বিশেষ করে ডিপ্রেশন, সোমাটোফরম পেইন ডিজঅর্ডার এ এরকম দীর্ঘ স্হায়ী ব্যথা থাকে
৩। কেউ শারীরিক সমস্যা / লক্ষণ নিয়ে দিনের পর দিন ভুগছে, 
অনেক ডাক্তার দেখাচ্ছে, কিন্তু তেমন ভাল ফল পাচ্ছে না,
যাবতীয় দামী দামী টেস্ট করেও ডাক্তার বলছে রিপোর্ট ভাল, কোন রোগ নাই---
এমন ক্ষেত্রে নিজেই বুঝে নিবেেন এটি একটি মানসিক রোগ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
৪। ৩ এর মতন রোগীদের কোন রোগ নাই বললে যেমন অন্যায় হবে, তেমনি এটি রোগকে জটিল করে তুলবে ও রোগীকে আত্মীয়দের কাছে তাকেছোট করা হবে।
মানুষ যে লক্ষণ নিয়েই আসুক,সেটি তার সমস্যা ও রোগ।
সেটি শারীরিক রোগ না বলে,টেস্ট ভাল বলে, এটি কোন রোগ নয় বলা অন্যায়। 
ডাক্তাররা এমন ভুল করলে রোগীদের যন্ত্রনা শুধু দীর্ঘ স্হায়ী হয় তা না,বিদেশে আমাদের ডাক্তারদের বদনাম ও হয়।একারনে কিছু রোগীর কাছে আমরা আস্হা হারাই।
৫। ঐ রোগীর "অবসেশনাল" ব্যক্তিত্বের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে
 (অতিরিক্ত দায়িত্বশীল,নিয়ম কানুনে অনড়,অনিয়ম দেখলে ক্ষিপ্ত হওয়া)।
অবসেশনাল ব্যক্তিদের " পারফেক্ট " হওয়ার প্রবনতা থাকে এবং এদের মধ্যে ডিপ্রেশন হওয়ার ও দীর্ঘ স্হায়ী আবেগ -আচরণ গত সমস্যা ( সাইকোজেনিক পেইন) ঝুঁকি বেশি থাকে।
৬। উনি ডিপ্রেশন এর রোগী। পুরো শরীরে ব্যথা বলে ডাক্তাররা এই রোগের চিন্তা মাথায় আনেনি। অথচ ডিপ্রেশনে বিভিন্ন রকমের শারীরিক লক্ষণ থাকতে পারে,বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা এর অন্যতম একটি লক্ষণ 
৭। ডাক্তাররা  ও সমাজ শারীরিক সমস্যাকে গুরুত্ব দেয়,মানসিক সমস্যাকে নয়।একারনে রোগীদের মধ্যে মানসিক যন্ত্রনা শারীরিক লক্ষণ হয়ে প্রকাশ পায়।একে বলা হয় " সোমাটাইজেশন"। আমাদের মতন উন্নয়নশীল দেশে তাই বেশির ভাগ মানসিক রোগী শারীরিক সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে হাজির হন।
 
No comments:
Post a Comment