Tuesday, October 2, 2018

তরুনদের মানসিক স্বাস্থ্য

কেমন আছেন আমাদের তরুনরা?
প্রশ্নটি রাস্ট্র, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার সবার প্রতি। অন্তত পরিবার কি খোঁজ নেয় তাদের যুবা বয়সের ছেলে মেয়েরা কেমন আছে? চেম্বারে ছেলেকে নিয়ে বাবা এসেছেন -অভিযোগ সামনে  এসএসসি  পরীক্ষা অথচ ছেলে এসময়ে স্কুল বদলাতে চাচ্ছে। কারন হিসেবে জানা গেল তার কয়েকজন বন্ধু অনেক দিন যাবত তাকে টিটকারি, তিরস্কার, অপমান করে যাচ্ছে।তাকে বন্ধুরা " সাপ" ও বেইমান বলে  এবং তাকে দেখলেই সাপের মতন "হিস হিস " শব্দ করতে  থাকে।  ফেইসবুকে তাদের  একটি গ্রুপ চ্যাট আছে,।কিছু দিন আগে সে গ্রুপের প্রোফাইল পিকে একটি সাপের ছবির মাথায় তার ছবি দিয়ে তারা পোস্ট দেয়।
ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার স্কুল কতৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয়নি? সে বলে তারা আরে ক্ষেপে যাবে এ ভয়ে কাউকে জানায়নি। বাবার কাছে জানতে চাইলাম আপনারা কি করেছেন? তিনি বলেন -আমরা তো কিছু জানতামই না।পরীক্ষার আগে স্কুল পরিবর্তনের গোঁ ধরাতে জানতে পারি।
আমরা পরিবারের সদস্যরা  অনেক পরে জানি আমার সন্তান মাদকাসক্ত,ধর্ষণে লিপ্ত, হত্যা খুনের সাথে জড়িত বা অন্য কোন অনৈতিক, অবৈধ কাজে লিপ্ত অথবা এই ছেলের মতন তারা বিপদগ্রস্ত, ব্লাকমেইলের শিকার বা হেনস্তা লান্চনা শিকার।
প্রতি বছর ১০অক্টোবর পালন করা হয় " বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য "দিবস।এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ঃ "পরিবর্তিত বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য"। অন্তত এ দিবসের প্রতিপাদ্যের কারনে হলেও আমাদের খোঁজ নিতে হবে আমাদের তরুনরা কেমন আছে।জাতিসঙ্গের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৪-২৮ বছর বয়সী ছেলে মেয়েরা হচ্ছে তরুন।
দিন দিন এ তরুনদের মাঝে বাড়ছে  অধৈর্যতা,স্হিতিহীনতা,সহিংসতা, আত্মহত্যা,মাদকাসক্তি সহ বিভিন্ন মানসিক রোগ।যাদের মানসিক রোগ হয় তাদের  ৫০% এর  ঐ রোগের প্রথম লক্ষণ ১৪ বছরের মধ্যেই দেখা দেয়। আবার লক্ষণ দেখা দেওয়া ও চিকিৎসা নেওয়ার মধ্যে ফারাক থাকে প্রায় ৫ বছর। আমাদের এই অজ্ঞতা ও অসচেতনতা কাটিয়ে উঠতে হবে, কেননা জীবনকে সুন্দর, স্বার্থক,সুখী করতে  হলে শৈশব থেকেই ভালো মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে।
কিছু সংখ্যা তথ্য ঃ কৈশোর -তারুণ্যে আত্মহত্যা হচ্ছে মৃত্যুর ২য় সর্বোচ্চ কারন( বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) ;প্রতি ১০ মিনিটে পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও একজন কিশোরী সহিংসতার কারনে মারা যায়(ইউনাইটেড ন্যাশনস চিলড্রেন ফান্ড) ;৮৩% তরুণ মনে করে বুলিং তাদের আত্মমর্যাদার উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে(ডিসথেলেবল ডট অরগ);ট্রান্স-জেন্ডার তরুনদের ৫১% আত্মহত্যার চিন্তা করে, ৩০% আত্মহত্যার চেষ্টা করে (সেন্টার ফর ট্রান্স ইউথ হেলথ এট চিলড্রেন হসপিটাল,লসএনজেলস) এবং ২০% তরুণ বিভিন্ন মানসিক রোগে ভুগে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) ।
সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা ঃ(১) সাইবার বুলিংঃউপরে যে স্কুল বদলানোর ছেলের কথা বলকাম এটি তার একটি উদাহরণ। ইমেইলে,টেক্সটে বা অনলাইন পোস্টে বিব্রতকর বা হুমকিজনক ছবি বা তথ্য দেওয়া ;এমন মন্তব্য ও পোস্ট যা ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে বা তাকে আহত করে ;অথবা আক্রমনাত্বক বা বিদ্বেষ মূলক যে কোন আচরণকে - সাইবার বুলিং বলা হয়।২০% জন নারী সাইবার বুলিং এর শিকার হন এবং ৯২% টিন-এজ প্রতিদিন অনলাইনে থাকে (স্টপ বুলিং ডট অরগ)। এরকম বুলিং এর জন্য হাজার হাজার ছেলে মেয়ে শুধু মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছে না,তারা পারিবারিক ও সামাজিক  সমস্যায় পড়ছেন, মানসিক রোগে ভুগছে, পড়াশোনা ক্যারিয়ার নষ্ট হচ্ছে সর্বোপরি অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে। (২) নির্যাতন ঃপরিবার ও অন্যত্র তরুণরা শারীরিক, মানসিক, যৌন ও আবেগীয় নির্যাতনের সম্মুখীন হয়।এছাড়া অবহেলা, বন্চিত হওয়া তো রয়েছেই।
(৩)সহিংসতা ও মাদকাসক্তিঃধর্ষন,হত্যা, ছিনতাই,  প্রভৃতি মারাত্মক অপরাধ মূলক কাজে অনেক তরুণ জড়িয়ে যাচ্ছে। গ্যাং কালচার, ডিসকো পার্টি সহ নানান রকম নিত্য নতুন অপকর্ম, অপসংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ছেন আমাদের সন্তানরা।(৪)আত্মহত্যা ঃপ্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৮ লক্ষ লোক আত্মহত্যা করে, এর মধ্যে তরুনদের মৃত্যুর ২য় সর্বোচ্চ কারন হচ্ছে আত্মহত্যা। ৭৮% আত্মহত্যা ঘটে আমাদের মতন নিন্ম ও মধ্যম আয়ের দেশে। আত্মহত্যার আচরণের মধ্যে রয়েছে -আত্মহত্যার চিন্তা বা পরিকল্পনা, আত্মহত্যার চেষ্টা ও আত্মহত্যা।
যেভাবে বুঝবেন কেউ আত্মহত্যার ঝুকিতে রয়েছেন কিনা ঃমরতে চাওয়া, নিজকে হত্যা করতে চাওয়ার ইচ্ছা পোষন;আশাহীন ও শুন্যতাবোধ,বেচে থাকার যুক্তি নেই মনে করা ;আত্মহত্যার প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ;জীবনের ঘেরাটোপে আটকে গেছি ও এর কোন সমাধান নেই মনোভাব ;অসহ্য যন্ত্রনা ( শারীরিক বা মানসিক) ;অন্যদের বোঝা হয়ে আছি মনে করা ;পরিবার, বন্ধু থেকে নিজকে গুটিয়ে নেওয়া ;ক্রোধ দেখানো, প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা ; আবেগ বা মন- মেজাজের অস্বাভাবিক উঠা- নামা ( তীব্র অশান্তি থেকে হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়া বা সুখী হয়ে উঠা।আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেললে অনেক রোগী "রিলিফ " ফিল করে ও সব যন্ত্রণার অবসান হতে যাচ্ছে ভেবে শান্ত হয় এমনকি সুখী ভাব দেখা দেয়)।
মনে রাখতে হবে যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় পরবর্তীতে আত্মহত্যা করার ঝুকি সাধারনের চেয়ে ৫০-১০০ গুন বেশি। আত্মহত্যার কথা বলা ও চেষ্টাকে তাই খাটো করে দেখার উপায় নাই এবং এরা প্রকৃত আত্মহত্যা করবে না এরকম ভাবা সঠিক না।(৪)নিজকে ক্ষত/আহত করা(সেল্ফ হার্ম)--আত্মহত্যার ইচ্ছে নেই তবুও নিজ ইচ্ছায় নিজকে আহত করা কিছু আবেগ তাড়িত তরুন তরুণীদের বদ অভ্যাসে দাড়িয়ে যায়।পরিবার, দাম্পত্য জীবন বা প্রেমের সম্পর্কে সামান্য মানসিক আঘাত পেলে, আকাঙ্খা পূরন না হলে বা ম্যানপুলেট করতে তারা হাত কেটে ফেলে, ঘুমের ঔষধ খায়,ক্ষতিকর কিছু গলাধকরন করে(স্যাভলন),শরীরের অংশ বিশেষ পুড়িয়ে ফেলে ইত্যাদি।
যা করনীয়ঃসামান্য কিছু ভাল কাজই অনেকের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। আমেরিকায় নিউইয়র্কে " মেন্টাল হেলথ এডুকেশন ইন স্কুলস 'ল " নামে একটি আইন পাস করা হয়েছে। এই আইনে নিউইয়র্কের কিন্টারগার্ডেন থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত সকল স্কুল কলেজে সকল ছাত্র ছাত্রীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য  বিষয়ে শিক্ষা দান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের দেশে ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে স্হান দিতে হবে। শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নানামুখী প্রচার ও প্রোগ্রাম রয়েছে। যেমন হাত ধেয়া,দাত মাজা,ভাল পুষ্টি, ব্যায়াম। একই রকম প্রচার ও প্রোগ্রাম মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য থাকবে না কেন?ঢাকা মেডিকেলে ছাত্র ছাত্রীদের "শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য " নিয়ে একটি ক্লাসের পর এক ছাত্রী জিজ্ঞেস করলো "স্যার টিভিতে আপনার সন্তানকে ওরস্যালাইন খাওয়ান বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়।আপনার ক্লাশ শুনে মনে হচ্ছে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে এরকম বিজ্ঞাপন দেওয়া আরো জরুরি "।
উন্নত দেশগুলোতে স্কুল কলেজ থেকেই "সোশাল ইমোশনাল লার্নিং " (এসইএল)  শেখানো হয়।এতে থাকে ঃআত্মসচেতন হওয়ার শিক্ষা ;আত্ম ম্যানেজমেন্ট কৌশল ;সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ;সম্পর্ক দক্ষতা ;দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা। এছাড়া তরুণদের শেখাতে হবে যে কোন চাপ,দুর্যোগ বিপর্যয়ের পর কিভাবে ঘুরে দাড়াতে হয় ও দুরুত স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করা যায়।এর মধ্যে রয়েছে  ঃসহযোগিতাপূর্ন ব্যক্তিগত সম্পর্ক ;সমস্যা সমাধানে ভাল দক্ষতা ;কখন,কোথায়, কার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে হবে তা জানা।
সর্বশেষে বলবো তরুণদের সঙ্গে যেন পরিবারের থাকে অকপট, খোলামেলা, সৎ যোগাযোগ,তাদের "ক্ষমতায়িত" করতে হবে যেন নিজ দায়িত্বে "পরিস্থিতি সামাল "দিতে পারে  এবং পরিবারে  যেন একটি " প্রযুক্তি মুক্ত "(টেক ফ্রি) সময় থাকে, যখন পরিবারের সবাই একত্র হয়ে নিজেদের মতন করে সময় কাটাতে পারেন।

প্রফেসর ডা. তাজুল ইসলাম
প্রফেসর অব সাইকিয়াট্রি
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।
ইমেইল ঃdrtazul84@gmail.com
Phone :01715112900 

No comments:

Post a Comment