Thursday, January 17, 2019

প্রতীকদের আত্মহনন রোধ করবো কিভাবে?

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র প্রতীকের আত্মহত্যা আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা, এর মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষক নিয়োগ ও এরগুনগত মান এবং উচ্চ শিক্ষায় সামন্ততান্ত্রিক মাফিয়া গোষ্ঠীর দৃশ্য -অদৃশ্য বেড়াজাল নিয়ে নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। আমি গত ১৫ মে ২০১৭-দৈনিক প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় কলামে -"পরীক্ষায় যারা ফেল করেছো বা করবে " শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম পরীক্ষায় কাঙ্খিত ফলাফল না পেয়ে যারা হতাশ ও ভগ্নমনোরথ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তাদের জন্য। প্রতীকের এই হ্রদয়বিধারক আত্মহননের পর বিষয়টির আরো গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি।
শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যমান "র্্যাংকিং বা গ্রেড" পদ্ধতির এবং শুধু একাডেমিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কৃতিত্ব মাপার  প্রচলিত ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে। অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, চাকরিদাতা -সবার কাছে মেধা ও সফলতার একমাত্র মানদণ্ড হয়ে দাড়িয়েছে এই তথাকথিত আই.কিউ বা একাডেমিক বুদ্ধিমত্তা।
কিন্তু আসলেই কি আমাদের রয়েছে কেবল একটি একক ও অনন্য বুদ্ধিমত্তা,নাকি আমরা "বহুমুখী বুদ্ধিমত্তা" ও ধারার(স্পেক্ট্রাম) অধিকারী?
এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ উচ্চ শিক্ষার বিদ্যায়তনে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া, শিক্ষকদের গুনগত মান ও নৈতিক মান নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। এর কারন এর সঙ্গে যেমন শিক্ষার গুনগত মান নির্ভর করে তেমনি প্রতীকদের মতন মেধাবী ছেলেমেয়েদের প্রকৃত মান যাছাই হচ্ছে কিনা তাও ও নির্ভর করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ৯০এর দশকের পর থেকে সর্বত্র, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষায়লয়ে শিক্ষক নিয়োগ কি প্রক্রিয়ায় হয় তা এখন সবার কাছেই " ওপেন সিক্রেট "।ঐসব " বিশেষ বিবেচনা " ছাড়া ও মেধার যে স্কোর সে গুলো সুকৌশলে "পেয়ে দিতে " বা কারো কাছ থেকে "কেড়ে নিতে " ঐ সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী একাট্টা হয়ে কাজ করে বলে অভিযোগ করা হয়।প্রতীকের বেলায় ও তেমন আপত্তি উত্থাপন করছেন তাদের আত্মীয়রা।উচ্চ শিক্ষায় যেখানে সব বিষয়ে "প্রশ্ন " করার,বিতর্ক করার অবাধ অধিকার থাকার কথা,মেধা -মনন বিকাশে উন্মুক্ত চিন্তা ধারাকে স্বাগত জানানোর কথা, জ্ঞান- মেধাকে যেখানে "ক্ষমতাতিয়ত" করার কথা,সেখানে এখন চলছে অন্ধ আনুগত্য, দলীয় বাছাইকরন বা ছাটাইকরন,গোষ্ঠীগত এমনকি অন্চলভিত্তিক পছন্দকরনের হিড়িক। আমরা কি অন্তত শিক্ষা,চিকিৎসা, বিচারালয় গুলোকে এই "কন্টক,কালিমা" থেকে মুক্ত করতে পারি না?

এতো গেলো মেধা মূল্যায়নে অসঙ্গতি ও দুর্নীতির কথা। কিন্তু যদি সঠিক ভাবে ও প্রচলিত পন্থায় মেধা যাছাই করা হয় সেই "মাপ-পদ্ধতি" ও কতটুকু গ্রহনযোগ্য এবং কাল-উপযোগী?১ম বিশ্ব যুদ্ধের পর স্টানফোর্ড-বিনেটের আইকিউ টেস্ট আবিষ্কার এর পর আমরা আইকিউ দিয়ে মেধা মাপার যুগে প্রবেশ করি।তবে বর্তমানে জানা গেছে আই কিউ জীবন সফলতায় বড়জোর ২০% ভূমিকা রাখে। বাকিটা নির্ভর করে অন্যান্য উপাদান বিশেষ করে "আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স" এর উপর। সংক্ষেপে যাকে "ই কিউ" বলা যায়।হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কৃতি অধ্যাপক হাওয়ার্ড গার্ডনার সর্বপ্রথম এই প্রথাগত আই কিউ এর ধারনাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন এটি বুদ্ধিমত্তা মাপার একটি সংকীর্ণ ধারণা। এটি ব্যক্তির দক্ষতা ও সক্ষমতার যে  বিশাল ব্যাপ্তি রয়েছে সেটিকে অস্বীকার করে। গার্ডনার বলেন আইকিউ ১৬০ যাদের তাদের অনেকেই আই কিউ ১০০ যাদের তাদের অধীনে কাজ করে। বিলগেটস নিজে বলেছেন তার চেয়ে ভাল রেজাল্ট করা অনেক বন্ধু তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে।
হার্ভার্ড স্টুডেন্টদের উপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে উচ্চ আই কিউ যাদের, মধ্য বয়সে পৌঁছে তাদের বেতনের মান,উৎপাদনশীলতা ও কর্মস্থলে পজিশন যারা মার্ক কম পেয়েছে তাদের থেকে তেমন উচ্চে ছিল না। বস্তির ৪৫০ বালকের উপর অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, যাদের আই কিউ ৮০ এর কাছাকাছি পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বেকার ছিল ৭%। অন্যদিকে যাদের আই কিউ ১০০ এর উপরে ছিল তাদের মধ্যে ও বেকার ছিল ৭%(কোন পার্থক্য নাই) ।

উচ্চতর আই কিউ বা একাডেমিক বুদ্ধিমত্তা অধিক উন্নতি,সম্মান বা সুখী হওয়ার গ্যারান্টি না দিলে ও আমরা অভিভাবকরা,পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,শিক্ষার্থীরা সবাই সেই সোনার হরিনের পিছনে ঃছুটছি -জিপিএ -৫ বা উন্নত গ্রেড এর পিছনে ।ভাল স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া না পাওয়া, সেখানে উচ্চতর গ্রেড পাওয়া না পাওয়াকে এজন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এতো গুরুত্ব দিয়ে দেখে থাকে, কারো কারো  জন্য যা "বাচা-মরা" বা " মানসম্মানের/ইজ্জতের  " প্রশ্ন হয়ে দাড়ায়।তখন অনেকেই সেই স্বপ্ন ভঙ্গ, আশা ভঙ্গের মনোবেদনায় মুছড়ে পড়ে।কেউবা হতাশায়,আত্মগ্লানিতে বা অভিমানে আত্মহত্যার মতন চরম পথ বেছে নেন।

কিন্তু আমরা ভুলে যাই আইকিউ নয়,ই কিউ বা  "আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা" জীবন সফলতার মূল চাবি কাঠি। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে মানুষের বিশেষ চরিত্র বা একসেট গুনের সমস্টি।বোস্টন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ক্যারেন আর্নল্ড বলেন "দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জানে কিভাবে সিস্টেমের ভিতরে থেকেও
সফলতা অর্জন করা যায়"। একই রকম উক্তি করেন সেভয়েই -" তারা আরো জানে কোন প্রতিষ্ঠান /শিক্ষালয়ে "না- বলা" (আনস্পোকেন)  কিছু রীতি নিয়ম রয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে তাদের খাপ-খাইয়ে চলতে হবে। এই না বলা রীতি নিয়ম গুলো হচ্ছে ঐ প্রতিষ্ঠানের "আভ্যন্তরীণ রাজনীতি "।
এই যে সিস্টেমের মধ্য থেকে ও সফল হওয়া বা প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীন রাজনীতি বোঝা -বর্তমান কুট কৌশলের যুগে এগুলো ও বুদ্ধিমত্তার অংশ।আমরা খুশী হতাম যদি সিস্টেমে গলদ না থাকতো, দুর্নীতি না থাকতো এবং কোন প্রতিষ্ঠানে বা শিক্ষালয়ে " গুপ্ত গোষ্ঠী গত আভ্যন্তরীন পলিটিক্স " না থাকতো। কিন্তু বিভাজিত এ সমাজ, কলূসিত এই সমাজ যতদিন বিশুদ্ধ না হচ্ছে, ততদিন আমাদের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে এই বৈরী, অসম,নীতিহীন সিস্টেমের সঙ্গেই পান্জা লড়ে টিকে থাকতে হবে।

গার্ডনার তার প্রভাবশালী "ফ্রেইমস অব মাইন্ড " বইতে একক বুদ্ধিমত্তার পরিবর্তে ৭টি  ধারা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।পরে উনি ও অন্যান্যরা এটি ২০ ধরনের হতে পারে বলে দাবি করেন। গার্ডনার বলেন "বুদ্ধিমত্তা কোন ম্যাজিক্যাল সংখ্যায়(৭ সংখ্যা) আবদ্ধ থাকার বিষয় নয়।
এসব বহুমুখী বুদ্ধিমত্তার অন্যতম হচ্ছে ঃ১।
আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা
(ইন্টার পারসনাল ইনটেলিজেন্স)-এটি হচ্ছে অন্যকে বুঝতে পারার সক্ষমতা।অন্যদের ম্যুড,মেজাজ, মোটিভেশন বোঝা ও সে অনুযায়ী সাড়া দিতে পারা বা প্রয়োজনে তা " নাকোচ" করে দিতে পারা;গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও কমন সেন্স;নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা;সম্পর্ক লালনপালন করতে জানা ও বন্ধুত্ব ধরে রাখতে পারা;সম্পর্কজনিত দ্বন্দ্ব নিরসন করার সক্ষমতা;ইত্যাদি। ২। সামাজিক বুদ্ধিমত্তা(সোশাল ইনটেলিজেন্স)- জীবন সফলতার জন্য" নিখুঁত সামাজিক মানচিত্র " ধারণ ও অনুধাবন গুরুত্বপূর্ন। এগুলো সে দক্ষতা যা আপনাকে সমাজে "তারকা" বানিয়ে দেবে।এর জন্য প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক  প্রায়োগিক জন-দক্ষতা ( প্রাকটিক্যাল পাবলিক স্কিল)।মাশরাফি, মমতাজ,হিরো আলম তেমন কিছু সামাজিক "তারকা "। সামাজিক বুদ্ধিমত্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্যকে বোঝার ক্ষমতা এবং মানবীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিজ্ঞতার সহিত আচরণ করতে পারা।৩।ইন্ট্রা-পারসোনাল ইনটেলিজেন্স-এটি হচ্ছে " সম্বন্বয়ধর্মী দক্ষতা ",নিজের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা রাখা। একে " আত্মজ্ঞানের " চাবিকাঠি ও বলা হয়।নিজের প্রকৃত আবেগ, আচরণের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সক্ষমতা।
রবার্ট স্টেনবার্গ এক গবেষণায় জনসাধারণের কাছে প্রশ্ন রাখেন তারা কাদেরকে "বুদ্ধিমান" মনে করেন। সে তালিকায় সবচেয়ে বেশী উল্লেখ ছিল -"যাদের বাস্তবভিত্তিক জন-দক্ষতা"রয়েছে। এই বাস্তবভিত্তিক জন দক্ষতা ও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বহু মুখী ধারার বিকাশ ঘটাতে আমেরিকা "প্রজেক্ট  স্পেক্ট্রাম " নামটা একটি কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। এই প্রজেক্ট এর মূল বক্তব্য হচ্ছে আমাদের ট্যালেন্ট এর স্পেক্ট্রাম বাড়াতে হবে। আমরা এমন শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করেছি যেখানে কেউ খুব সফল হলে বড়জোর কলেজ /ভার্সিটির প্রফেসর হতে পারবে। আমাদের উচিত হবে বর্তমানের "র্্যাংকিং বা গ্রেড " সিস্টেমের বদল করে শিক্ষার্থীদের নিজেদের সক্ষমতা,গুনাবলীকে শনাক্ত সহায়তা করে ও সেগুলোর যত্ন নেয় তেমন পদ্ধতির প্রবর্তন করা।
সফলতার রয়েছে শত শত পথ ও পন্থা এবং আমাদের প্রত্যেকের রয়েছে অনন্য ও অসীম সম্ভাবনা। প্রত্যেকেই তার নিজের পথ, প্রতিভা ও অভিনব কৌশলে নিজকে উদ্ভাসিত করতে পারেন ও জীবনে সফল হতে পারেন। এর জন্য ভাল ফল করতেই হবে, বিশেষ পেশা বা চাকরি পেতেই হবে, নির্দিষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতেই হবে  এমন বাধ্যবাধকতা নেই। এই বহুমুখী বুদ্ধিমত্তার মূলে রয়েছে আমাদের মানসিক গঠন  বা নিউরাল স্ট্রাকচার।এই স্ট্রাকচার নমনীয়, এগুলো  স্বভাব ও সাড়া প্রদানের এক সেট অবস্থান। প্রতিটি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এগুলো শেখানো যায়,এর পরিচর্যা নেওয়া যায়। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার শত ফুল ফুটতে দিলে,জন দক্ষতা, সমাজ দক্ষতা, আবেগীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে শুধু মাত্র পরীক্ষায় ভাল ফল না করতে পারার হতাশা, গ্লানি, অভিমান শিক্ষার্থীদের অতলে নিমজ্জিত করে দিতে পারবে না।আমরা তেমন শিক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও জীবন পদ্ধতির বাস্তবায়ন চাই।

No comments:

Post a Comment