Wednesday, March 20, 2019

সাইকিয়াট্রিস্ট এর জার্নাল -৪২ঃজগতের সকল প্রাণী সুখী হোক/সুখী মানুষরা একত্রে থাকে

প্রতি বছর ২০ মার্চ "বিশ্ব সুখ দিবস " পালন করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে "সুখী মানুষরা একত্রে থাকে " (হ্যাপিয়ার-টুগেদার)। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের মধ্যে কিছু কমন বৈশিষ্ট্য ও উত্তারাধিকার রয়েছে। এই প্রতিপাদ্যের তাৎপর্য হচ্ছে, আপনি মানব জাতির যে বিভেদ, বিদ্বেষ সেটিকে উসকে না  দিয়ে, মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি না করে, আমরা যেন মানব জাতির কমন বৈশিষ্ট্য, প্রয়োজন ও প্রবনতার দিকে বেশি মনোযোগ দেই।

যে জাতিগত ও ধর্মীয় উগ্রবাদ আমাদের বিচ্ছিন্নতা, বিভক্তি বাড়াচ্ছে, তার বিপরীতে আমাদেরকে একত্রে থাকতে হবে, একসঙ্গে থাকতে হবে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চের বিয়োগান্তক ঘটনার পর সে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও জনগণ যেভাবে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা,সংহতি প্রকাশের যে অনন্য নজির স্হাপন করেছেন, তা অন্যদের জন্য একটি বড় উদাহরণ হতে পারে।

আমরা বিভক্ত সমাজ চাই না, একত্রিত মানব জাতি চাই। আর একসঙ্গে থাকা মানুষরাই সুখী মানুষ। বিচ্ছিন্ন, অন্ধকারে ঘাপটিমেরে থাকা সন্ত্রাসীরা কখনো সুখী মানুষ হতে পারে না।

২০১২ সনে জাতিসংঘের স্পেশাল এডভাইজার জেয়মি ইলিয়েন(jayme Illien) বিশ্ব সুখ বৃদ্ধি, একত্র করা ও উন্নয়নের জন্য ২০ মার্চ বিশ্ব সুখ দিবস পালনের প্রস্তাব করেন।বিশ্বের ১৯৩টি দেশ ২০১২ সনের ২৪ জুলাই এই প্রস্তাব রেজুলেশন ৬৬/২৮১ নামে সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে জাতি সঙ্গের তৎকালিন মহাসচিব বান-কি-মুন মন্তব্য করেন "টেকসই উন্নয়নের জন্য  উন্নয়নের যে তিনটি স্তম্ভ -সামাজিক, আর্থিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন -এসবের মধ্যে সমতা আনতে হলে, বলে অর্থনীতির একটি নতুন নমুনা /ধারা নির্মাণ এখন অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে"।
এই দিবসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্প্রতি ১৫-১৭ মার্চ,২০১৯, আমেরিকার মিয়ামিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস সামিট।

লাইবোমিরস্কি ও তার সহযোগীদের গবেষণায় (২০০৫)প্রমানিত হয়েছে যে সুখী মানুষরা অন্যদের থেকে জীবনে অধিক সফল হন,দীর্ঘজীবি হন ও অধিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন।কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর কো-অপারেশন এন্ড কনফ্লিক্ট রিজুলেশন এর পরিচালক মি. পিটার কোলম্যান সুখের গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলেন -" বিশ্ব সুখ সূচকের সঙ্গে বিশ্ব শান্তি সূচকের রয়েছে ঘনিষ্ট সম্পর্ক"।
মনে রাখতে হবে অসুখী মানুষ হতাশ,ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ ও বেপরোয়া মানুষ। তাদের দ্বারা আর যাই হোক শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব না।

ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০১৮ অনুযায়ী ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫-তে।ভারত -১৩৩,পাকিস্তান -৭৫। সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় রয়েছে ঃফিনল্যান্ড,নরওয়ে,ডেনমার্ক, আইসলেন্ড, সুইজারল্যান্ড। ঘুরে ফিরে এরাই বারবার সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় থাকে। সবচেয়ে কম সুখী দেশের তালিকায় রয়েছে ঃব্রুন্ডি,সাউথ সুদান, তানজানিয়া, ইয়েমেন।

পশ্চাৎপট ঃ১৯৭২ সনে তৎকালীন বোম্বেতে ফিনানশিয়াল টাইমস এর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ভুটানের প্রাক্তন রাজা সর্বপ্রথম  জিএন এইচ(গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) টার্মটি ব্যবহার করেন।তিনি বলেন "জিএনপি (গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট)  এর চেয়ে জিএনএইচ এর গুরুত্ব অনেক বেশি। "
এরপর ২০০৫ সনে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট দ্বিতীয় জিএনএইচ এর প্রবর্তন করেন। ২০০৬ সনে এই প্রতিষ্ঠান আমেরিকায় জিএনএইচ বাস্তবায়নের জন্য পলিসি হোয়াইট পেপার প্রকাশ করেন।২০০৭ সনে থাইল্যান্ড সরকার জিএইচআই( গ্রীন এন্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্স)  প্রকাশ করেন। ২০০৯ সনে আমেরিকায় গ্যালপ ওয়েল বিং ইনডেক্স চালু করেন।২০১০ সনে সেন্টার ফর ভুটান স্টাডিজ তাদের পূর্বতন ৪ স্তম্ভের বদলে সুখের উপাদান হিসেবে ৮টি উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করেন।সেগুলো হলোঃ শারিরীক, মানসিক ও আধাত্মিক স্বাস্থ্য ;সময়ের ভারসাম্য ;সমাজ ও কমিউনিটির প্রাণশক্তি ;সাংস্কৃতিক প্রাণশক্তি ;শিক্ষা ;জীবন -মান;গুড গভর্নেন্স ;ও পরিবেশ প্রাণশক্তি। ২০১১ সনে কানাডা সি আই ডব্লিউ(কানাডিয়ান ইনডেক্স অব ওয়েল বিং)  প্রকাশ করেন।২০১২ সনে জাতিসংঘ ২০ মার্চকে বিশ্ব সুখ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।

সুখ কি মাপা যায়?
এমন কোন বাটখারা কি রয়েছে যা দিয়ে সুখের পরিমাণ মাপতে পারি?  মনোবিদরা তেমন মাপন যন্ত্র আবিস্কার করেছেন। এই মাপন যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে ঃ১। পি এ এন এ এস( পজিটিভ এন্ড নেগেটিভ এফেক্ট সিডিয়ুল) ২। এস ডব্লিউ এল এস (স্যাটিশফেশন উইথ লাইফ স্কেল)  ৩। এস এইচ এস(সাবজেক্টিভ হ্যাপিনেস স্কেল)

সুখ কি? সুখের সংজ্ঞা কি,সুখ কোথায়, কোথায় এর ঠিকানা, সুখের কি কোন গোপন রেসিপি রয়েছে -নাকি সুখ কেবলই সোনার হরিন?  এসব প্রশ্ন আদিকাল থেকে মানব মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সুখী থাকা মানে এই নয় আপনি কখনো অসুখী থাকেন না।সুখের প্রচুর সংজ্ঞা রয়েছে, তবে কোনটাই সর্বজন স্বীকৃত নয়।

রবার্ট হোলডেন সুখের একটি সংজ্ঞা এভাবে দেন" বাহ্যিক উপাদানের সঙ্গে সুখ শর্তযুক্ত  বা সুখ কিনতে পাওয়া যায় -এরকম বিশ্বাসকে মাইনাস করে, আপনার যে প্রকৃত অবস্থান -সুখ সেটিই।"কথায় আছে -টাকা সুখ কিনতে পারে না। তেমনি ক্ষমতা, সম্পদসহ বাহ্যিক কোন উপাদানের সঙ্গে সুখ শর্তযুক্ত নয়।

রবার্ট হোলডেন "ডেসটিনেশন এডিকশন" বলে একটি টার্ম ব্যবহার করেন।এরমানে সুখের পিছনে হন্যে হয়ে যারা সারাজীবন দৌড়ান,সেটি এক ধরনের নেশা। হেথা নয়,হোথা নয়-অন্য কোথা, অন্য  কোন খানে--এরকম মনে করে, আমরা অনেকেই সুখের সোনার হরিনের পিছনে ছুটে  সারাজীবন পার করে দেই।তবুও মনে হয় সুখের নাগাল তো পেলাম না।

তাহলে সুখ কোথায়?

মনোবিদরা বলেন সুখ কোন বিশেষ জায়গায় নয়,সুখ নির্ভর করে কিভাবে আপনি জীবন যাপন করেন তার উপর। আপনি কিসের উপর বেশি মূল দেন?অর্থ,সম্পদ,ক্ষমতা, সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা? এই মুহূর্তে কি আপনাকে সুখী করতে পারে? এসব বিষয়ে একেক জনের একেক মত থাকবে। তাছাড়া যা আপনাকে সুখী করবে তা অন্যকে নাও করতে পারে। তবে এতো কিছু সত্বেও পজিটিভ সাইকোলজি বলে, আমরা সুখ সৃষ্টি করতে পারি, সুখ বৃদ্ধি করতে পারি এবং নিশ্চিত ভাবে সুখী হতে পারি।

কিভাবে সুখী হবেনঃ

ডোপামিন নামক একটি নিউরোট্রান্সমিটারকে "ভালো লাগার হরমোন " বলা হয়। গভীর  ভালোবাসা বা মাদক যে তীব্র আনন্দ দেয়, তা এই ডোপামিনের জন্যই।নানা প্রক্রিয়ায় আমরা ব্রেইনের ডোপামিন লেবেল বাড়াতে পারি।
তবে
নিয়মিত ব্যায়াম করুন ;আশাবাদী জীবন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করুন ;জীবনে যা পেয়েছেন, হয়েছেন তার হিসেবে করুন, কি পাননি তা নয়;কোন বিষয়েই কারো সঙ্গে নিজেকে তুলনা করবেন না- কেননা মূলত জীবনে তুলনা বলে কিছু নাই। আপনি এ পৃথিবীতে অনন্য ও অসাধারণ ;কৃতজ্ঞ থাকুন ও তা প্রকাশ করুন-স্রস্টা আপনাকে অজস্র নেয়ামত দান করেছেন, পরিবার, সমাজ,আত্মীয়, বন্ধুগন থেকে অনেক কিছু পেয়েছেন।-এসব ভুলে থাকা অকৃতজ্ঞতা।তাই প্রতিদিন স্রস্টার কাছে অন্যদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন ও এ জীবনে যা পেয়েছেন, হয়েছেন তার জন্য গর্ব ও তৃপ্তি অনুভব করুন;বর্তমানে বাচুন,বর্তমানে জীবন যাপন করুন,অতীত,ভবিষ্যত বা অন্য কিছু যেন মনোযোগকে বিঘ্নিত করতে না পারে -একে আমরা বলি মাইন্ডফুলনেস;যারা আনন্দ দেয়,সম্মান করে তাদের সঙ্গে থাকুন ;জীবনে ভালো মন্দ বিরক্তি -যা আসুক তা মেনে নিন;যা করছেন গভীর মনোনিবেশ দিয়ে করুন, এতে নিমগ্ন হয়ে যান,এর মধ্যে ডুবে থাকুন -একে বলে ফ্লো;আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান বৃদ্ধি করে তেমন কিছু করুন;যা কিছু ভালো তা ধরে রাখুন,যা কিছু মন্দ সেসব "চলে যেতে " দিন ;জীবনের একটি বিশাল মানচিত্র ধারন করুন,যেরকম জীবন চান সেরকম জীবন গড়ে তুলুন(তবে এপিজি আবুল কালামের কথা মনে রাখবেন -স্বপ্ন সেটি নয় যা আমরা ঘুমে দেখি,স্বপ্ন হচ্ছে তা যা আমাদেরকে ঘুমাতে দেয় না);ভালোবাসুন- মানুষকে,প্রানীকে,প্রকৃতিকে;বেরিয়ে পড়ুন,ঘুরতে যান,প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকুন;কাছের মানুষদের "ধন্যবাদ " এর বার্তা পাঠান;ভালো আছি,সুখে আছি এটি হোক নিত্যদিনের জপ মন্ত্র ;শেয়ার করুন নিজের আনন্দ সুখকে;জীবনে অনেক ভাবে বাঁচা যায়,এক পথ বন্ধ হলে শত পথ খুলে যাবে।
বাঙ্গালী উৎসব প্রিয় জাতি। বিশ্ব সুখ দিবস জাতীয় ভাবে পালনের দাবি জানাচ্ছি। এদিন আমরা নেচে,গেয়ে আনন্দ উল্লাসে দিন কাটাবো। সবাই একত্রে থাকবো,একসঙ্গে জীবন উপভোগ করবো। নিজের জন্য ও অন্যদের জন্য সুখ সৃষ্টি করবো।

No comments:

Post a Comment